নাটক-সিনেমায় চিত্রায়নের আগে পুলিশকে জানুন

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 3 June 2020, 10:43 AM
Updated : 3 June 2020, 10:43 AM

ইউটিউবে 'নানা রঙের মানুষ'  নাটক দেখছিলাম। কাহিনীকার হলেন আহসান আলমগীর। আমি নাট্যকার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। তবে 'সাত নাট্যকারের গল্প' গ্রন্থে যে নাট্যকাররা লিখেছেন তাদের মধ্যে তিনিও একজন। 

নাটকের শুরু হল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ডিএমপির ডিবির একটি দলের একজন আসামি গ্রেফতার অভিযান দিয়ে। একজন লেডি অফিসারসহ তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা মিলে একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতারের জন্য পিস্তল হাতে ছুটছে। শহরের অলি-গলিতে ধাওয়া দিয়ে একসময় তারা ক্লান্ত আসামিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেন।  আসামির মাথায় তিনটি পিস্তল ঠেকানো হল। নড়াচড়া করলেই পুলিশ তিন দিক থেকে গুলি করতে পারে। নাটক পুলিশের ভাবখানা এমন যে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখালেই আসামি কোনো প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমপর্ন করবে।

কিন্তু বিধি বাম! মাথায় ঠেকানো তিনখানা পিস্তলকে উপরে রেখে আসামি মাথা নিচু করে  পানিতে ডুব দেওয়ার কৌশলে পুলিশের ঘেরাও ভেঙ্গে দে ছুট। তারপর আবার ধাওয়া। একটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে আসামি আশ্রয় নিলে সেখানে চলল তুমুল গোলাগুলি। এক পুলিশ আহত। অন্য দুজন আসামিকে পরাস্থ করল। এক অফিসার আসামির পেছন দিকে গিয়ে আগের মত তার মাথায় পিস্তল ঠেকালো। এবার দুজনই সশস্ত্র। কিন্তু আসামি কোনো প্রতিরোধ করল না। তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে নিয়ে আসা হল ডিবি অফিসের জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে।

পুলিশের কার্যপদ্ধতি ও অভিযান প্রক্রিয়া সম্পর্কে একজন কাহিনীকার যে কত অজ্ঞ এ নাটকের ঘটনা দেখে তা সহজেই বোঝা যায়। গ্রেফতার অভিযানের কোনো পর্বেই  কোনো পুলিশ অফিসারের কাছে হাতকড়া দেখা গেল না। হাতকড়া পরানোর পরিবর্তে তারা আসামির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে কার্যোদ্ধারের চেষ্টা করেছে। গোলাগুলির সময়ও দেখা গেল একই প্রকারের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। 

জিজ্ঞাসাবাদের নামে যা হলো তা কিছুটা ন্যাকামি বলা চলে।  আসামির ব্যক্তিগত জীবন জানার চেষ্টা না করেই চলে তার উপর নির্যাতন। পুরুষ অফিসারের পূর্বেই নারী অফিসারকে দেওয়া হল জিজ্ঞাসবাদ করতে। নারী অফিসার শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন যে তিনি কোনো অংশেই 'কম পুলিশ' নন।

সিনেমার ঘটনায় নাটকীয়তা থাকবেই। কিন্তু নাটকীয়তা নির্বুদ্ধিতা নয়। বাল্যকালে দেখা  কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ছে। বাহিনীতে একটি অন্যতম পুলিশ চরিত্র ছিল এটিএম শামসুজ্জামান। তিনি ছিলেন একজন ট্রাফিক হাবিলদার। তার বড় আক্ষেপ যে  তিনি হাবলিদার থেকে সুবেদার হতে পারলেন না।একদিন মেয়ের কাছে এ আক্ষেপের এক পর্যায়ে তিনি বলছেন, 'যাইরে মা, ডিআইজি সাহেব, আবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন'।

চলচ্চিত্রটি যে সময়ে তৈরি করা হয়েছিল সে সময় পুলিশের ডিআইজি তো দূরের কথা একজন এএসপির কাছেও সামান্য একজন হাবিলদারের প্রবেশাধিকার ছিল না। সিনিয়র অফিসারদের কাজ খুব যদি বেশি নিচে নামতো, তা থানার অফিসার-ইন-চার্জদের পর্যন্তই সীমীত থাকত। ডিআইজি সাহেবদের এএসপিরাও কালেভদ্রে দেখতে পেতেন। তার কাজ মূলত নিচের দিকে এসপিদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। একজন হাবিলদারকে একজন ডিআইজি ডেকে পাঠানোর ঘটনা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের কোনো ইউনিটেই স্বাভাবিক নয়। কিন্তু  দেখা যাচ্ছে্ আমাদের কাহিনীকাররা এই খবরটুকু পর্যন্ত রাখেন না।

প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও কবি হুমায়ুন আজাদকে একবার বলেছিলাম, "স্যার, অনেক বিষয়েই তো লিখলেন। এবার পুলিশ নিয়ে কিছু লিখেন না কেন?"

সরল স্বীকারোক্তিতে সব্যসাচী এই লেখক বললেন, "ভাইরে, পুলিশ সম্পর্কে আমি তো তেমন কিছুই জানি না।"

আমি ধন্যবাদ দেই প্রয়াত হুমায়ুন আজাদকে। তিনি পুলিশ সম্পর্কে জানতেন না বলে পুলিশকে নিয়ে লিখতেন না বা তার লেখনিতে পুলিশের কোনো প্রসঙ্গ আনতেন না।

পুলিশকে নিয়ে অনেকেই লিখছেন। দুঃখের বিষয় তারা পুলিশের জীবন ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে না জেনেই  লিখছেন। 

ভারতের বলিউডের পুলিশ নিয়ে নির্মিত প্রায় সকল চলচ্চিত্রই আমার দেখা। এসব মুভির কাহিনীতেও ফ্যান্টাসি ও নাটকীয়তা আছে। কিন্তু আমার মতে, ঐসব কাহিনীতে নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ দেখা যায় না। এটুকু বুঝতে পারি, কাহিনীকার বা স্ক্রিপ্ট লেখকরা পুলিশের ভেতরের খুঁটিনাটি ভালভাবে জানার পরই তাদের কাহিনীগুলো তৈরি করেন।

একথা ঠিক যে কোনো এক সময় বঙ্গভারতে পুলিশ সাধারণ মানুষের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অগম্য। পুলিশকে অত্যাচারী শাসকের নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে দেখে হয় আগে থেকেই। লেখক-সাহিত্যিকরা যেমন পুলিশ এড়িয়ে চলছেন, তেমন পুলিশও কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে হাত দূরে থাকতেন। কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পুলিশের মিথস্ক্রিয়ার একমাত্র উপায় ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখী হওয়া।

কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে লেখক ও পুলিশ কেউ কারো শত্রু নয়, প্রত্যেকেই একটি স্বাধীন দেশের সন্তান; সমানমাত্রায় দেশপ্রেমিক। তাই পুলিশের দুয়ার এখন সবার জন্য উন্মুক্ত । যে কেউ ইচ্ছে করলে পুলিশ সম্পর্কে জানতে পারছেন, পুলিশের কাজের ধরন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন। তাই এই সময়ে এসে, নাটক-চলচ্চিত্রে পুলিশকে জেনেই পুলিশ চরিত্র চিত্রায়ন করা দরকার বলেই মনে করি।