কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সার্বজনীন ‘বঙ্গবন্ধুবাদ’

আলমগীর কবির
Published : 24 April 2018, 01:24 AM
Updated : 24 April 2018, 01:24 AM

আমাদের দেশে ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে স্থাপনার নাম বদল, কৃতিত্ব অস্বীকার এবং সঠিক ইতিহাস ধামাচাপা দেয়ার একটা প্রথা চলে আসছে বহুকাল ধরে। ক্ষমতার পালাবদলে মহান স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা প্রভৃতি বিষয় নিয়েও ঘটে অনেক মারাত্মক ঘটনা। নামের আগে অনেক অনেক উপাধি যুক্ত করে ব্যক্তির নামও পাল্টে যায় অনায়াসে।

কিন্তু তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে হওয়া সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে এই নামধাম ও ইতিহাস পরিবর্তনের কু-প্রথার বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। আন্দোলনে দেশের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের যে ধ্যান-ধারণা, চেতনা, মননশীলতা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে, তার দ্বারা বুঝা গেল এরাই সঠিক ইতিহাসের ধারক ও বাহক। এদের হাতে কখনো ইতিহাস বিকৃতি ঘটবে না। জাতির পিতাকে মানতে রাজী না থাকা ধর্ম ব্যবসায়ীদের অহেতুক সব যুক্তির অগ্নিরথ ঠেলে দিতেও পিছু পা হবেনা এই তরুণেরা।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে হওয়া এই আন্দোলন যে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে হয়েছে তেমনটি নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্র-ছাত্রী এখানে আছে। তবে কোন উগ্র রাজনৈতিক দলের কেউ নেই এটা একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমার বিশ্বাস। বাম-ডান কিংবা ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সবারই এই দাবির সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে। এসবের উর্ধে গিয়ে সব থেকে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- তাদের চেতনা ও সঠিক ইতিহাস লালন করার বিষয়টি। জাতির পিতা শেখ মুজিব তাদের সকলের প্রথম আদর্শ!

হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড ও গায়ে লেখা বঙ্গবন্ধুময় সব উক্তি, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও শ্লোগানে যে প্রতিবাদের ভাষা- তা যেন অতীতের সব ছাত্র আন্দোলনকেও ছাড়িয়ে যায়। প্ল্যাকার্ডে কিছু লেখা স্থান পেয়েছে যা তাদের আন্দোলনকে নতুন মোড় এনে দেয়। এই যেমন- 'আমরা মেধাবী, মাথায় গুলি কর, মেধাবী মরে যাবে; কিন্তু বুকে গুলি নয়, কারণ এই বুকে বঙ্গবন্ধু ঘুমায়', "শেখ মুজিব আমার পিতা, আর আমাকেই বলেন রাজাকারের বাচ্চা?'- এমন অনেক জ্বালাময়ী বক্তব্য ও প্রতিবাদের ভাষায় উঠে এসেছে '৫২ থেকে '৯০ এর ছাত্র আন্দোলনের পরিস্ফুটন।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে আজ অবধি 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' আওয়ামী লীগের শ্লোগান, শেখ মুজিব তাদের একক নেতা। কিন্তু এই আন্দোলন জাতির পিতাকে সেই পিতার আসনই দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভেসে বেড়ায় রাজনীতির কবি খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অসংখ্য লাইন, যার বেশিরভাগই এই আন্দোলনে বেগ এনে দেয়ার মত কথা।

শেখ মুজিবুর রহমান এখন আর কোন একক রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দলের নয়, সবার। লেলিন, মহাত্মা গান্ধি, নেলসন মেন্ডেলা যদি তাদের জাতির কাছে একক নেতা হয়ে থাকতে পারে, তবে বঙ্গবন্ধু কেন নয়? আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দেখেছি, ভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মতাদর্শে থেকেও বজ্রকন্ঠে বলছে- "জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু"। পাশাপাশি বড় যে জিনিসটা উঠে এসেছে তা হলো এদের ইতিহাস সচেতনতা।

তরুণ প্রজন্মের এই যে ইতিহাস সচেতনতা, তা আমাদের সুদূর প্রসারী ফল দিবে। নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানবে তাদের থেকেই, ক্ষমতার পালাবদলে শাসকশ্রেণি পাল্টালেও ইতিহাস পাল্টানোর অপচেষ্টা রহিত হয়ে যাবে এই তরুণদের মাধ্যমেই। 'বঙ্গবন্ধুবাদ' যে এখান থেকেই শুরু হলো তা-ও বলা যায়। 'বঙ্গবন্ধু কারো একার নয়, সবার'- এই ধারণা রাজনীতি সচেতন অধিকাংশ মানুষের বিবেকে আজ অবস্থান করছে। কিন্তু এতকিছুর পরও যারা তার প্রকাশটা করতে পারে না তা তাদের নিজ স্বার্থরক্ষার জন্যেই হয়তো। কোটি বাঙালির হৃদয়ে ও চেতনায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাক চিরকাল।