Published : 08 Nov 2017, 02:21 PM
কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন এনভায়রনমেন্ট দিয়ে বাপা-বেন এর বিশেষ কনফারেন্স চলছিল। সময়টা ২০১৬ সাল। অনেকের অনেক ধরনের গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হচ্ছিল বিভিন্ন কক্ষে। কেউ পলি নিয়ে, কেউ চিংড়ি চাষ আর লবণ চাষ নিয়ে, কেউ সুন্দরবন এলাকার নদীর মৎস প্রজাতি নিয়ে। একজনের গবেষণার বিষয়বস্তু মাকড়সা! তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জঙ্গলে প্রাপ্ত মাকড়সার প্রকার ও স্বভাব বৈচিত্র সম্পর্কে জানালেন। গবেষক ব্যক্তি নিখাদ মাড়কসাপ্রেমীও ছিলেন। তিনি মাকড়সাকে ভয়ংকর কোনো প্রাণী না বলতে প্রয়োজনীয় তথ্যউপাত্তও পেশ করলেন। তার উপস্থাপনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন বিস্ময় প্রকাশ করলেন, মাকড়সার উপরেও গবেষণা! এবং মাকড়সাও একটি উপকারী প্রাণী! মাড়কসার বাহ্যিক অবয়ব এবং বর্ণের ধরণের কারণেই মাকড়সা ভীতি সকলের মধ্যে বিরাজ করে। কোনো বিশেষ প্রজাতির মাকড়সা ক্ষতিকর নয় জানলেও এই ভীতি কমবে না। অথচ মাকড়সাটি নির্দোষ।
নির্দোষ মাকড়সা ভয় জাগালেও বাহ্যিক গড়ন আর রঙের পূর্ণতা নিয়ে মনে চঞ্চলতা জাগিয়ে তোলে প্রজাপতি। বলা হয়ে থাকে বিশ্বপ্রাকৃতির বৈচিত্রে ১৮০০০ প্রজাপতি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। এর চেয়েও অবাক হচ্ছে প্রজাপতি নিয়ে নানা ধরণের গবেষণাও হয়। বিশ্বের কথা বাদই দিলাম, আমাদের দেশেই রয়েছে প্রজাপতি গবেষণা কেন্দ্র।
২০১৫ সাথে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্বোধন হয় প্রজাপতি উদ্যান এবং গবেষণা কেন্দ্র (The Butterfly Park and Research Centre)। 'উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি' স্লোগান নিয়ে এটিই দেশের প্রথম প্রজাপতি উদ্যান ও গবেষণা কেন্দ্র। তবে সবুজঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন প্রজাপতির জন্য অভয়ারণ্য আরো আগে থেকেই। প্রজাপতির রঙে এ প্রাঙ্গণ এমনিতেই বর্ণিল। তার উপর কয়েক বছর আগে চালু হলো প্রজাপতি মেলা। এক এক করে হয়ে গেল ৮ম প্রজাপতি মেলাও!
গত প্রায় ৩ বছর ধরে প্রজাপতি মেলায় যাবো যাবো করছি। বার বার সে সুযোগ ফসকে যাচ্ছিল। এবার ফেসবুক ইভেন্টে কড়া নজর ছিল। যে দিনই হোক না কেন যেতে হবেই! এবং ছোটখাট দলবল নিয়ে শনিবার ৪ নভেম্বর রওনাও দিয়ে ফেললাম। পথে শকট এর জট ভাগ্যক্রমে কম ছিল। দ্রুত পৌঁছে গেলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখ পেরিয়ে বর্ণিল নড়াচড়ায় প্রজাপতি মেলার মূলমঞ্চ খুঁজে নেয়া গেল।
প্রজাপতি নিয়ে গান চলছিল কিছুক্ষণ পর পর। জায়গাটা রঙিন তো ছিলই, সুরে সুরে সমধুরও হয়ে উঠল। কিন্তু প্রজাপতি কোথায়? ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের রঙিন পোশাকে সবাইকেই প্রজাপতি লাগছিল। সবার মাথার উপর দিয়ে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছিল। মেলার দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষভাবে একটা জালের ভেতর গাছপালা আর প্রজাপতি রাখা ছিল। সেখানে সবুজ প্রজাপতি। হলুদ প্রজাপতি। খয়েরি প্রজাপতি। বাচ্চা থেকে বুড়ো, জালের উপর চোখ রেখে, ক্যামেরা নিয়ে প্রজাপতিকে ডিজিটালে ধারণ করতে উৎসুক। কিন্তু প্রজাপতি তো চপল। দর্শনার্থীরা রোদের নীচে ঘাম ছুটিয়ে প্রজাপতির ঠায় বসার অপেক্ষায়। এ যেন কিশোর-কিশোরিদের প্রজাপতির পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে মাঠ-গ্রাম-বন পেরুনোর উত্তেজনা। আমিও সেমি-ডিজিটাল লেন্স তাক করে রইলাম। প্রজাপতি ধরবই!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ২০১০ সাল থেকে প্রজাপতি সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতির ভূমিকা তুলে ধরে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে প্রজাপতি মেলার আয়োজন করে আসছে।
সবুজ প্রজাপতিটা দেখতে মনে হচ্ছিল একটা সবুজ ঘাগড়া পরে উড়ছে, জালে জালে বসছে।
খয়েরি প্রজাপতিটাকে ক্যামেরায় আটকানো সহজ ছিল না!
র্যালির জন্য বানানো ফুল, প্রজাপতির উজ্জলতায় হেসেখেলে উঠেছিল ক্যাম্পাস।
বিভিন্ন রকমের প্রজাপতি – গবেষণা ও জ্ঞানের জন্য।
জহির রায়হান মিলনায়তনেই ছিল প্রজাপতি মেলার উদ্বোধনী মঞ্চ।
বিশ্বব্যাপী প্রজাপতির উপর গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য জাপানের গ্র্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটি ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিস বিভাগের প্রফেসর কেনটারো আরিকাওয়া'কে 'বাটারফ্লাই এওয়ার্ড-১৭' প্রদান করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে অসংখ্য প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা হয়েছিল।
প্রজাপতি মেলা উপলক্ষ্যে ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজনও।
প্রজাপতি রঙে রেঙে উঠেছিল শিশুর গাল।
আমিও এত এত রঙ থেকে আর চিত্রকরের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। তাই তো হাতে ফুটে উঠলো প্রজাপতি। ছবিটি তুলেছিল প্রিয় ছোটভাই আশীক আল অনিক ।
এবং এবার অনিকের গালেওে উড়তে শুরু করলো প্রজাপতি।
অনিক এবার নিজেই রঙ-তুলির চিত্রকর। একটা অন্যরকম প্রজাতি আঁকার চেষ্টারত।
তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে।
ক্যাম্পাসে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরে ছিল বেশ বড় জালের এক প্রজাপতি জগত। এখানে দর্শনার্থীদের জালের ভেতরে ঢোকার সুযোগ দেয়া হয়। একপাশের জাল তুলে লাইনে দাঁড়ানো দর্শনার্থীদের কিছু কিছু ভেতরে যেতে পারে। ভেতরে অনেক গাছ আর ফুল। ফুলে ফুলে উড়ছে, বসে আছে চুপটি করে রঙিন প্রজাপতি। আবার কিছু ঝুলন্ত প্লেটে আনারস ও ফুল দিয়ে রাখা হয়েছে প্রজাপতিদের বিশেষ খাবার হিসেবে আকর্ষণ করতে। সারি ধরে এক পাশ দিয়ে এই জগতে প্রবেশ করে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় দর্শনার্থীদের। কোনো টিকেট বা প্রবেশ মূল্য ছিল না।
শীতের পাখি দেখা ছিল প্রজাপতি মেলায় আনন্দক্ষণের পরে এক বাড়তি পাওনা। পুকুরের পানিতে পদ্ম তো ছিলই অল্পস্বল্প। তবুও ভরা ভরা লাগছিল পুকুরটা অনেক বেশি। ওগুলো আসলে শীতের পাখিদের। যখন নড়ে উঠছিল, গলা বাড়িয়ে দিচ্ছিল, পড়ন্ত রোদে দুয়েকটা উড়ে যাচ্ছিল, তখন চোখে ধরা পড়ছিল এত এত পাখি পুকুরে!
প্রজাপতি, শীতের পাখি, একরাশ সবুজ আর অতুলনীয় রঙের আবেশ নিয়ে বিকেল বেলা ঢাকা ফিরতে হলো।