Published : 22 Sep 2017, 12:02 PM
মোটা চালের দাম বাড়লো কেন? কেন নির্বাচনী ইশতিহারে প্রচারিত ১০ টাকা কেজির চাল আমাদেরকে এখন ৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে? কেন সরকার মোটা চালের পরিবর্তে আমাদেরকে আতপ চাল কিনতে উৎসাহ দিচ্ছে? কেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিক্রিত ১৫ টাকা কেজি দরের চাল এক লাফে ৩০ টাকা হয়ে গেল? এর দায়ভার কী শুধুই সরকারকে দেব?
মোটা চাল নিয়ে এতগুলো 'কেন' প্রশ্নের কালো মেঘ মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মনের এই কালো মেঘগুলো মুছে ফেলতেই এই লেখার অবতারণা। আসুন, প্রশ্নগুলোর জবাব বের করার চেষ্টা করি।
শুরুতেই বলে রাখি, এই জবাবগুলো একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা। এর সাথে সরকার বা সরকারী ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের কোন রকম সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই আমার বক্তব্যকে কেউ সরকারী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাববেন না।
জাতি হিসেবে আমরা এমন যে, কোন বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে সবার সাথে তাল মেলাতে মেলাতে একসময় নিজেরাই সেই গুজবে বিশ্বাস করতে শুরু করি। চালের দাম বাড়ার ক্ষেত্রেও এরকম গুজব কাজ করেছে বলে আমাদের অন্তত দু'জন (খাদ্য ও বাণিজ্য) মন্ত্রী মনে করেন। আর এই গুজব ছড়ানোর জন্য তারা সাংবাদিকদেরকেই দায়ী করেছেন! তাদের কথা, সাংবাদিকরা গুজব ছড়ানোর কারণেই চালের দাম বেড়েছে৷ কারণ সাংবাদিকরাই সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়েছে যে বাংলাদেশে বর্তমানে চালের ঘাটতি রয়েছে। আসলে আমাদের চালের কোনো ঘাটতি নেই৷
আসুন, এবার দেখি সাংবাদিকরা আসলেই গুজব ছড়িয়েছেন কিনা।
দেশের বিভিন্ন অটো রাইস মিলে অভিযান চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই চাল জব্দ এবং জরিমানা করছে। কারণ সরকারের কাছে খবর ছিলো, কেউ কেউ চাল গুদামে রেখে দাম বাড়াচ্ছে৷ এই অভিযোগে রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলিকে পাঁচ দিন আগে গ্রেপ্তারের নির্দেশও দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী৷ তবে শেষ পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি৷ তারা মঙ্গলবার ঢাকায় এসে মন্ত্রণালয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফয়েল আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে করে গেছেন কোন বাধা ছাড়াই৷ বৈঠকের পর দুই মন্ত্রী জানিয়েছেন, মিলারদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই চালের চাম নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে৷
খেয়াল করুন, মিলারদের সাথে আলোচনার পর মন্ত্রীর বক্তব্য, 'চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে।' যদি বাংলাদেশে চালের ঘাটতিই থাকতো, তাহলে কি মন্ত্রী চালের দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলতে পারতেন? কারণ চালের ঘাটতি থাকলে তো দাম নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া চালের ঘাটতি থাকলে, যেসব চাল জব্দ হয়েছিলো সেসব চাল এলো কোথা থেকে? তার মানে চালের ঘাটতির খবরটা আসলেই গুজব ছিলো।
খাদ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ''সংবাদ মাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছিল তিন মাস ভারত চাল দেবে না৷ আর এ কারণেই চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়৷ এর সঙ্গে মজুদদারী তো ছিলই৷ তবে আমরা মজুদদারীর বিরুদ্ধে অভিযান এবং খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু করায় চালের দাম এখন কমছে৷ ভবিষ্যতে আরো কমবে৷" অর্থাৎ চালের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমরা শুধু সরকারকেই দায়ভার দিতে পারছি না। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে চালের দাম কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমরা আতপ চাল কেন খাবো? কেন সরকার আমাদের আতপ চাল খাওয়ার ব্যপারে উৎসাহ দিচ্ছে? আসুন এই বিষয়টা একটু খোলাসা করি।
বন্যা এবং ব্লাস্ট রোগের কারণে এবার চলতি মাস পর্যন্ত ২০ লাখ টন চালের ঘাটতি তৈরি হয়৷ আর এই ঘাটতি মেটাতে সরকার চাল আমদানি শুরু করে৷ সরকারি পর্যায়ে সাড়ে চার লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন আছে৷ গত জুলাইয়ে ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ টন আতপ চাল আমদানি করা হয়৷ এছাড়াও ভারত থেকে ২ লাখ টন আতপ ও সেদ্ধ চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে৷ কিন্তু ভারত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চাল না দেয়ার সিদ্ধান্তের খবর (খবরটির সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে) সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলেই চালের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়৷ এর আগে খাদ্যমন্ত্রী মিয়ানমারে চাল আমদানির জন্য গেলেও তিনি চুক্তি সই করে আসতে পারেননি৷ এটাও অবশ্য চালের বাজারে প্রভাব ফেলে৷ পরে কিন্তু চলতি সপ্তাহেই মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে এক লাখ টন আতপ চাল বাংলাদেশে রপ্তানির চুক্তি করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর সরকারের হাত নেই। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট চালের ঘাটতি পূরণে সরকার চাল আমদানিতে করেছে। এক্ষেত্রে সিদ্ধ চাল না পেয়ে সরকার (বাধ্য হয়ে) আতপ চাল আমদানি করেছে। কারণ যেকোন মূল্যে সরকারকে চালের ঘাটতি পূরণ করতে হতো।
এখন আপনারাই বলুন, আতপ চাল আমদানি করে সরকার কি করে আমাদের সিদ্ধ চাল দেবে?
সরকারী ব্যবস্থাপনায় চালের দাম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা কেন হলো, এটাও এখন আমরা জানি। এটা যে ওএমেসের দাম বৃদ্ধির কারণেই হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই সবাই অবগত। তাই এই বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলছি না।
অর্থাৎ চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। আমরাও আশা করছি খুব শীঘ্রই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
আমরা অন্তত এই দিক থেকে তো নিশ্চিত হতে পারি যে বর্তমান সরকার তত্বাবধায়ক সরকারের মত বলবেনা, 'বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান।'