বিমূর্ত ধারণা বনাম মূর্ত সম্পর্ক
সাধারণত আত্মসত্ত্বা ও নৈতিকতাকে পুরুষ দেখে একভাবে, আর নারী দেখে ভিন্ন ভাবে। এই দুই দেখার মধ্যে সারগত, পদ্ধতিগত, কাঠামোগত ও তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক রয়েছে। নারীর দৃষ্টি বেশী নিবদ্ধ সরাসরি যত্নের দিকে, আঘাত না করার দিকে, অন্যের আবেগানুভূতির সাথে একাত্ম হয়ে সহানুভূতির সাথে সাড়া দেবার দিকে, এবং সম্পর্ক সংরক্ষণের দিকে। কিন্তু পুরুষের নজর অধিকার, কর্তব্য, নিষ্পক্ষতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি বিমূর্ত ধারণার দিকে। পুরুষ যৌক্তিক কায়দায় সার্বিক ধারণা প্রকাশক শব্দ দিয়ে সূত্র প্রণয়ন করে, সেসব সূত্র থেকে যৌক্তিক কায়দায় কর্তব্য নির্ধারণ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুরুষ সূত্র তৈরি করে যে, মানুষের উচিত অন্যকে সহায়তা করা। এখানে "মানুষ" ও "অন্য" সবই বিমূর্ত সার্বিক ধারণা। কিন্তু নারী সরাসরি কর্তব্য কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করে উপস্থিত মূর্ত-নির্দিষ্ট বিপন্ন ব্যক্তি মানুষটির বাস্তব সিচুয়েশন বিবেচনা করে। পুরুষ নীতিবিদরা ভাষাগত প্রতিরূপ বা সিম্বল নিয়ে অতিরিক্ত হৈচৈ করে, আর নারী এতোসব বিচিত্র কথার ধার ধারে না—তারা সরাসরি সহায়তাকামীকে সহায়তা করতে এগিয়ে যায় যখন তাকে অসহায় অবস্থায় দেখতে পায়। এই নীতি-প্রবণতা ও প্রত্যক্ষ যত্নের মধ্যে কাঠামোগত ও প্রয়োগগত যে মৌলিক ও বিস্তর ফারাক রয়েছে তার উপর নারীবাদী নৈতিকতা তাত্ত্বিকদের মধ্যকার যত্নবাদীরা জোর দিচ্ছেন। এদের মতে, নৈতিকতা শেষ বিচারে তত্ত্বে নয় অনুশীলনে বাস করে। পুরুষ নীতিবিদরা তাদের তত্ত্ব দিয়ে যেখানে পৌঁছতে চায়, নারী সেখানে সরাসরি গিয়ে উপস্থিত হয়। তাহলে এতো তত্ত্ববিলাসের দরকার কী? এই প্রশ্নের উত্তর পুরুষ দেয় তার মনস্তত্ত্ব অনুসারে, আর নারী দেয় তারটা অনুসারে। গভীরভাবে দেখলে দৃষ্ট হয়ে উঠতে হতে পারে যে, পুরুষ বিমূর্ত ধারণার—যেমন ইচ্ছা, সূত্র, শুভ, চিন্তা ইত্যাদি—উপাসক হতেই বেশী পছন্দ করে, যেখানে নারী প্রকৃত ভূমিতে অস্তিত্ববানের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় প্রয়োজনীয় যত্নমূলক কাজগুলো সম্পাদন করে নিজ অস্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। মোট কথা, কান্টের "ভাল ইচ্ছা", নীটশের "ক্ষমতার ইচ্ছা", "শর্তহীন আদেশ" বা "সুবর্ণ বিধি" ইত্যাদির চেয়ে "যত্ন" ধারণাটি নৈতিকতার প্রকৃত ক্ষেত্রের অনেক নিকটবর্তী।
স্বাধীন অহং বনাম সম্পর্ক সূত্র
পুরুষের নৈতিকতা-চিন্তার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা আত্মসত্ত্বার বিকাশ, আত্মনির্ভরতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ইত্যাদির কথা অত্যধিক মাত্রায় বলে বলে এমনভাবে উচ্ছ্বসিত হয় যে, জীবনের প্রকৃত বিকাশটা বুঝি সর্বাংশেই বৌদ্ধিক বা আত্মিক বা মানসিক কিছু। পুরুষ নিজেকে শোভা মণ্ডিত একটি দ্বীপের মতো তৈরি করতে চায়, এক রাজ্যে এক রাজার মতো গড়ে উঠতে চায় একচ্ছত্র আগ্রাসীর মতো। কিন্তু নারী নিজের সত্ত্বাকে দেখে একাধারে একটি আত্মসত্ত্বা বা বিষয়ী (self বা subject) হিসেবে এবং বাইরের দিকে প্রসারিত নানা সম্পর্কের নালীর একটি গ্রন্থির ধারক হিসেবে। পুরুষের সত্ত্বা শেষ বিচারে চিন্তা, বুদ্ধি, যুক্তি, ইচ্ছা ইত্যাদির মধ্যে বিদ্যমান কিছু একটা হয়ে উঠে। অন্যদিকে নারীর সত্ত্বা গ্রন্থিবদ্ধ সম্পর্কনালীসমূহসহ অস্তিত্ববান—যেখানে সে এই নালীগুলো দিয়ে রস সম্পর্ক-সূত্রে আবদ্ধ অন্য সত্ত্বাগুলোর দিকে প্রবাহিত করে—তার সম্পর্কসূত্র যেন মূর্ত, যেভাবে মায়ের গর্ভে সন্তান যুক্ত হয়ে থাকে নাড়ী দ্বারা। পুরুষের চিন্তায় 'self-determination' ধারণাটি প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে নারীর নৈতিক আচরণের প্যাটার্নকে ভালভাবে প্রকাশ করতে পারে 'response' ধারণাটি। তুমি কে?—এই প্রশ্নের উত্তরে পুরুষরা সম্ভবত খুব বেশী করে "আমি" (আমি এই, আমি সেই ইত্যাদি) শব্দটি ব্যবহার করে থাকে এবং নারী ব্যবহার করে "আমার" (অমুক আমার ইত্যাদি) শব্দটি। "আমি"র বিষয়গুলো উৎকটভাবে আত্মনির্ধারণমূলক ও "আমার"য়ের বিষয়ীগুলো অন্যের সাথে সম্পর্ককে প্রকাশিত করে। পুরুষের অহংবাদী তত্ত্বপ্রীতির মনস্তত্ত্ব থেকে ভাল ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কেন সে নারী-বন্দনার কাব্য রচনা করে এবং একই সাথে বাস্তবে নারী-নির্যাতন করে থাকে অথবা নিদেন পক্ষে নারীর অযত্ন করে। সে ভাবের রাজ্যে নারীকে ঈশ্বরের সাথে তুল্য করে তোলে এবং একই সাথে বাস্তবে তাকে কবরবাসী করে রাখে—যার দুটোই আতিশয্য ও নারীর জন্য ফাঁকি ছাড়া কিছু নয়। আরও একটি উপমা দেয়া যেতে পারে। মা তার পুত্রকে ধারণ করেন, বেদনাসহ প্রসব করেন ও যত্ন দিয়ে বড় করেন। বড় হয়ে পুত্র মায়ের সাথে কী সদাচরণ করতে হবে তার সূত্র তৈরি করে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার দিন যায়। কিন্তু অযত্নে মায়ের যখন মৃত্যু ঘটে তখন মায়ের ছবি দেয়ালে টাঙ্গিয়ে ফুল দিয়ে ঘিরে রাখে।
স্বাধীনতা বনাম নির্ভরশীলতা
পুরুষের নৈতিকতা চিন্তায় স্বাধীনতাকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে—কান্ট ও নীটশে তার চরম উদাহরণ; আর এরাই আমাদের মানস-কাঠামো গড়ে তুলেছেন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, যেখানে পারস্পরিক নির্ভরতাকে মোটেই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তাদের বই পড়লে মনে হয়, মানুষ বুঝি রোবটের মতো হুট করে রেডিমেড চিন্তক বা অহং হিসেবে নিজেকে কোন ফ্যাক্টরি থেকে সৃষ্ট ও আবির্ভূত হতে দেখে, তার জীবনে বুঝি শৈশব ও বার্ধক্য বলে কোন পর্যায় নেই। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে আরও বড়: মানুষ সারা জীবন ধরেই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক নির্ভরশীলের জন্য যত্ন প্রয়োজন। রুশোর কথা, মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। কিন্তু মানুষ শিশু হয়ে জন্মায় ও মায়ের উপর এমনভাবে নির্ভরশীল থাকে যে, মায়ের যত্ন ছাড়া তার জীবন রক্ষাই দায়। কাজেই মানুষের স্বাধীনতা যেমন জন্মগত অধিকার, তেমনই নির্ভরশীলতাও তার অরিজিনাল কন্ডিশন। কান্টের বুদ্ধি মমতাকে একটি অনুসিদ্ধান্তে পর্যবসিত করেছে যা মূল প্রতিপাদ্যের ডামাডোলে হারিয়ে গিয়েছে, আর নীটশের অতিমানব তো প্রকাশ্যে মমতা ও নৈতিকতার ঊর্ধ্বেই বসবাস করে। পুরুষের নৈতিকতা দর্শনে কখনোই—সেই সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল থেকে শুরু করে আজকের উদারনৈতিকতাবাদীরা, উপযোগবাদীরা, কান্ট ও নীটশে তক—যত্ন, মমতা, সম্পর্ক তথা পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে যথোপযুক্ত গুরুত্বসহ বিশ্লেষণ করা হয়নি। ফলে তারা কার্যত মানুষে-মানুষে বিচ্ছেদ, দূরত্ব, হানাহানি ও যন্ত্রণা বৃদ্ধিতেই পরোক্ষে সহায়তা করেছেন। অন্যদিকে, নারী নিজেকে দেখে নানা সম্পর্কসূত্রের জটিল নেটওয়ার্কের একটি নোড হিসেবে, যেখানে সে ও অন্যরা সকলেই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল ও পারস্পরিক যত্নের মুখাপেক্ষী।
মাতৃঋণ ও পুরুষের দারিদ্র্য
পিতৃ-মাতৃঋণ পরিশোধ নিয়ে মুসলিম আইনবেত্তাদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে। তারা পিতৃঋণ পরিশোধ-সম্ভব বলে মনে করেন। যদি কারও পিতা দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন এবং তার সন্তান যদি তাকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় তবে পিতৃঋণ শোধ হয়েছে বলে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু মাতৃঋণ পরিশোধের কোন ভাল উপায় তারা দেখাতে পারেননি। ওমরের কাছে একজন এসে বলেছিলেন, "আমি আমার মাকে কাঁধে নিয়ে রোদের মধ্যে মায়ের হজের সমস্ত কাজ সম্পন্ন করেছি, এতে কি আমার মাতৃঋণ শোধ হয়েছে?" উত্তরে ওমর এই মর্মে বলেছিলেন, "তোমাকে প্রসব করার যন্ত্রণার প্রথম ক্ষুদ্র একটি অংশের ঋণটুকুও তুমি শোধ করতে পারনি।" যত্ন-নৈতিকতাবাদীরা বিশেষভাবে নারীর মাতৃ-মনস্তত্ত্বের মধ্যে যত্নের প্রকৃত রূপ দেখে থাকেন। প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষের (নারী-পুরুষ) মাতৃঋণ সম্মিলিত নারী সমাজের নিকট সমগ্র মানবজাতির ঋণ—তা ব্যক্তিনারীরা ব্যক্তিপুরুষদের মা হোক, কি বোন হোক, কি স্ত্রী হোক, অথবা কি কন্যাই হোক। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কন্যার বেলায় মাতৃঋণ বলতে কী বুঝায়? পুরুষের মাতৃঋণের সাথে নারীর মাতৃঋণের দশা একরূপ নয়। কন্যা নিজে আবার মা হয়ে নতুন ঋণ তৈরি করতে পারে। গর্ভ ধারণের সামর্থ্য ও সম্ভাবনার কারণে কন্যা তার মাকে বলতে পারে, "মা তোমার কাছে আমার যতটুকু ঋণ আছে আমিও তো ততটুকু আমার সন্তানদের কাছে পাওনাদার; সেটা পেলে তো তা তোমাকে দিয়ে দিতে পারতাম।" কিন্তু গর্ভ ধারণের সামর্থ্যের অভাবগ্রস্ত পুরুষসমাজের পক্ষে ঋণটি নিয়ে এরকম কথা বলার সুযোগটাও নেই। একারণে একথা বলা সম্ভব যে, সার্বিকভাবে নারী সমাজের কাছে সার্বিকভাবে পুরুষ সমাজেরই পরিশোধ-অসাধ্য মাতৃঋণ রয়েছে। আর এজন্য তাকে নারী সমাজের উদ্দেশ্যে জীবনভোর কাজ করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই—তা-ও আবার এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে যে, এভাবে কাজ করে মরলেও সেই ঋণ পূর্ণরূপে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ফলে সর্বপ্রচেষ্টায় কাজ করে ঋণ যতটুকু সম্ভব পরিশোধের চেষ্টা করে যাওয়া ছাড়া তার অন্য গতি নেই।
নারীর বিচার ও পুরুষজীবনের সাফল্য
উপরের কথাগুলো বিবেচনায় রেখে এবার নবীর একটি কথার দিকে আমরা মনোযোগ দিতে পারি। তিনি পুরুষদের লক্ষ্য করে বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।" নবী স্ত্রীকে এখানে বিচারকের ভূমিকায় বসিয়েছেন কেন? কারণ পুরুষরা মা, বোন বা কন্যার প্রতি যত অবহেলা করে, বা অবিচার করে তার তুলনায় স্ত্রীর সাথে করা অবিচার-অবহেলা অনেক অনেক বেশী। নারী প্রধানত স্ত্রী-রূপেই নির্যাতিত-অসম্মানিত হয়ে থাকে। আবার মা-বোন-কন্যা সাধারণত নিজের পুত্র-ভাই-পিতাকে এমনিতেই ভাল বলে মনে করে থাকে। আসল বিচারটি পাওয়া যায় স্ত্রীর কাছ থেকেই, যদিও স্ত্রী অপছন্দের স্বামীর প্রতিও একটি করুণা বা মমতা অনুভব করে থাকে। স্ত্রীর বিচারই সম্মিলিত নারী সমাজের বিচার। নারীসমাজ বিচার করবে তাদের নৈতিকতা দ্বারা—অর্থাৎ সম্পর্ক ও যত্নের মানদণ্ডে। কাজেই একথা বলা যায় যে, পুরুষের সমস্ত অর্জনই নৈতিক আধেয় বা মূল্য বা সারবত্তা বর্জিত হবে যদি সে তার অর্জনকে নারীর যত্নে ব্যবহার না করে, এবং মানবসমাজের যত্নে সেভাবে নিয়োজিত না করে যেভাবে নারী তার সম্পদ ও সামর্থ্য নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে পুরুষকে যদি ভালর বিচারে উত্তীর্ণ হতে হয় তবে তাকে তার আকাশচুম্বী বিমূর্ত তত্ত্বের মধ্যে কোন না কোন ভাবে মূর্ত যত্ন-নৈতিকতার তত্ত্বকে সন্নিবিষ্ট করতে হবে যথেষ্টভাবে এবং সেটি কার্যত অনুসরণ-অনুশীলন করতে হবে নিষ্ঠা ও সর্বপ্রচেষ্টার সাথে। কিন্তু পুরুষের ভারি ভারি কথার স্বাধীন-স্বায়ত্বশাসিত আত্মসত্ত্বার ধারণা সম্বলিত নীতি-নৈতিকতাকে নারী যদি তাদের যত্ন-নৈতিকতায় সন্নিবিষ্ট না-ও করে তবুও তাতে তার কোন ঘাটতি হয় না। কারণ তার মধ্যেও একটি নিজস্ব আত্মসত্ত্বার ধারণা রয়েছে যা যত্নের মধ্য দিয়ে বাস্তবতই বিকশিত হয়।
নারী-পুরুষ মিথোস্ক্রিয়া
যে সমাজে নারীরা অবরুদ্ধ, অসন্তুষ্ট, অবিকশিত, যে সমাজের পুরুষেরা নারীর মুক্তি, সন্তোষ ও বিকাশের প্রয়োজনে ও লক্ষ্যে পুরুষদের গড়ে উঠার ধরণকে সচেতনভাবে নির্ধারণ করে না, নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সেই লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে না, সেই পুরুষসমাজ নৈতিক বিচারে দেউলিয়া। মানবসমাজের প্রকৃত উন্নয়ন ও বিকাশের সূচক অফিস-আদালত, গ্রন্থাগার, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, আর্ট গ্যালারী ইত্যাদির মধ্যে বিরাজ করে না—এরা সকলে মূল্যবান হতে পারে যদি সেগুলো নারীর মুক্তি, সন্তোষ ও ব্যক্তি হিসেবে বিকাশের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। নারী ও পুরুষের মূল বাসভূমি হচ্ছে পরিবার। একটি ভাল সমাজ হচ্ছে সেই সমাজ যে সমাজটি গড়ে উঠেছে সুখী ও সুস্থ পরিবারের পুঞ্জ হিসেবে। একটি ভাল পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তার অন্তর্ভুক্ত নারী সদস্যদের জন্য কাজ করে। তাহলে নারীদের কাজ কী? ভাল পরিবারে নারীদের কাজও পুরুষদের অনুরূপ। এই পারস্পরিক কর্মের সম্পর্ক রাজা-সেবিকা বা রাণী-শ্রমিকের সম্পর্ক নয়—বরং তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি যত্নশীলতার সম্পর্ক। রাজা-সেবিকার সম্পর্ক নারীকে দেখে উপকরণ হিসেবে; সন্তান উৎপাদনের উপকরণ, সন্তান লালনপালনের উপকরণ। নারী এখানে কাজ করে ও তার বিনিময়ে সে বেঁচে থাকার উপকরণগুলো পায়। নারীর ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশটি এখানে প্রাধান্য পায় না। অন্যদিকে রাণী-শ্রমিকের সম্পর্কটিতে পুরুষ উপকরণে পরিণত হয়। পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোটি এমন যে, সচেতন ও সাবধান না হলে নারীকে উপকরণে পর্যবসিত করা থেকে নিজেকে সে রক্ষা করতে পারবে না। সচেতনভাবেই হোক বা প্রচ্ছন্নভাবে, বা অসচেনভাবেই হোক না কেন, পুরুষরা প্রায়শই পুরুষ-নারীর সম্পর্ককে রাজা-সেবিকার সম্পর্কে কার্যত পর্যবসিত করে—আর এটি হচ্ছে নারীকে উত্তরাধিকারে পর্যবসিত করা। অন্যদিকে, নারীর মধ্যে দ্বিবিধ প্রবণতা একই সাথে চলমান থাকতে পারে: সে দেনা-পাওনার হিসাব ছাড়াই তার মমতাকে বিস্তৃত করতে পারে এবং সেইসাথে পুরুষকে নিজের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার উপকরণ হিসেবেও গণ্য করতে পারে। তবে মোটের উপর নারীর মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোটি পুরুষের চেয়ে অনেক কম অহংবাদী। পুরুষ তার মনস্তত্ত্বের ভেতরে বিদ্যমান আগ্রাসী ইচ্ছা ও স্বার্থ-কেন্দ্রিকতা দ্বারা পৃথিবীকে কলুষিত করে রাখায় এবং নারীর উপর নিজের ইচ্ছা আরোপ করে রাখায় নারী নিজেকে নিজের মতো করে বিকশিত করতে পারছে না, তার সামর্থ্যকে পূর্ণভাবে প্রকাশিত করতে পারছে না। আমাদের সামাজিক কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যম সঞ্চালিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—সবই পুঁজির সহায়ক করে গড়ে তোলা হয়েছে। পুঁজি সব কিছুকেই পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে। এর ফলে সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অসমাপ্ত