বাস্তবতা টান ফেলেছে লক্ষ্মীর প্রসাদেও

আত্মকেন্দ্রিকতা, সামাজিক আদান-প্রদান কমে যাওয়া, একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকেও কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2022, 03:41 PM
Updated : 9 Oct 2022, 03:41 PM

লক্ষ্মীপূজায় আগের মতো নাড়ু-সন্দেশ না পেয়ে নিরাশ হলেন রাশেদ আহসান; তিনি মুসলিম হলেও প্রতিষ্ঠানে সহকর্মীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সনাতন ধর্মাবলম্বী রয়েছে বলে আশায় ছিলেন তিনি। কিন্তু নাড়ু-সন্দেশ আসেনি।

দুর্গাপূজার পর লক্ষ্মীপূজা ধরে তিলের নাড়ু, নারিকেল আর ক্ষীরের সন্দেশ, লুচি, সুজি, নানা রকম মিষ্টান্নের আয়োজন বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে হয়ে আসছে। বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ এবং খাওয়া-দাওয়ার এই পালায় প্রতিবেশী মুসলমানরাও ভাগ পেয়ে আসছে।

কিন্তু এখন সেই আয়োজনেই ভাটা পড়েছে বলে জানালেন সনাতন ধর্মাবলম্বী কয়েকজন নারী, যারা নিজেরা ছোটবেলা থেকেই এই ধরনের আয়োজন দেখে আসছিলেন।

তেমনই একজন কর্মসংস্থান ব্যাংকের কর্মকর্তা পম্পা কর, যিনি পূজা করতে লক্ষ্মীপুর থেকে নোয়াখালীতে গেছেন শ্বশুরবাড়িতে। তার মতে, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে আগের সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার আগ্রহ নেই।

পম্পা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মা-মাসি-পিসি-দিদা যারা ছিলেন বা আছেন, তাদের মধ্যে এই ব্যাপারগুলো শেখার বা এগুলো বাঁচিয়ে রাখার যে প্রবণতা ছিল, এখন তা কম। আগের মতো এগুলোর এতটা আদান-প্রদান এখন আর হয় না, কারণ এসব তৈরি করা সময় সাপেক্ষ, আবার ব্যয় সাপেক্ষও।”

এখন অনেকে বাড়িতে খাবার না বানিয়ে অনলাইনে অর্ডার করে কিনে আনেন। তবে তা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণেও অনেকে মিষ্টান্ন তৈরি করে প্রতিবেশীদের খাওয়ানোর সামর্থ্য হারিয়েছে বলে মনে করছেন পম্পা কর।

চাঁদপুর জেলার কোড়ালিয়া রোড এলাকায় বাবা, মা আর বোনের সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার সরঞ্জাম জোগাড়সহ পূজার আয়োজনে থাকা চাঁদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কাব্য কণিকা ঘোষের মতে, সামাজিকতা রক্ষা আর বাড়িতে লোকজন নিমন্ত্রণ করাটা এখন ‘ঝামেলা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা অনেক কমে গেছে। একসময় যাও একটু মজা হত, করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার পর সেটায় অনেকটাই গ্যাপ হয়ে গিয়েছে। এখন সবাই ঝামেলামুক্ত থাকতে চায়। আগে কত রকমের সন্দেশ হত! এখন নামমাত্র অল্পকিছু তৈরি হয়।”

এখন বেশিরভাগ ঘরে স্বামী-স্ত্রী দুইজনই কর্মজীবী হওয়ায় বাইরের কাজের চাপ সামলে পূজায় বাড়তি আয়োজন এড়িয়ে চলেন বলেও মনে করেন কাব্য।

এবার একা হাতেই চট্টগ্রামের পিলখানার মুরাদপুর এলাকায় নিজের বাসায় লক্ষ্মীপূজার সরঞ্জাম জোগাড় থেকে শুরু করে ঘর সাজিয়েছেন প্রতিমা রায় অধরা।

রোববার বেশ আনন্দের সঙ্গেই স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে দিনটি উদযাপন করছেন তিনি।

ছেলেবেলার লক্ষ্মীপূজায় বাড়ির দিনগুলোর স্মৃতি মনে করে প্রতিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলেবেলায় মাকে দেখতাম লক্ষ্মীপূজার দিন সকাল থেকে কাঁসার থালাবাসন তেঁতুল দিয়ে মেজেঘষে একদম পরিষ্কার করে রাখত। তারপর সন্ধ্যা হলে ঠাকুর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। কে কার আগে পুরোহিত ডেকে পূজা সারতে পারবে, এই নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা থাকত।

“সন্ধ্যার পর পূজা সেরে রাতে এ বাড়ি ও বাড়ি যেতাম লক্ষ্মীর ঘর কীভাবে সাজানো হয়েছে, সেটা দেখার জন্য। সবাই প্রসাদ দিত, সেগুলো খেতাম। খিচুড়ি রান্না করে বিলি করা হত।”

এখন মানুষ অনেকটাই ‘আত্মকেন্দ্রিক’ হয়ে গেছে মন্তব্য করে প্রতিমা বলেন, “এখন পূজা শুধু নিজেদের মধ্যে আর ফেইসবুকেই সীমাবদ্ধ। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং আমাদের বাস্তব সামাজিকতাকে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। এখন আর আগের মতো ঘোরাঘুরিও হয় না।

“এখনকার সময়ে বেশিরভাগ লোকই ডায়াবেটিকজনিত জটিলতায় ভোগেন। তাই ঘরে ঘরে মিষ্টি আর নাড়ু তৈরির ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। যার কারণে নাড়কেল নাড়ুটা এখন আর সব বাড়িতে পাওয়া যায় না। আমি নিজেও তেমন ভালো বানাতে পারি না। তাই এবার সেটা বানানো হয়নি।”

বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে বছরজুড়েই দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়ে থাকে। তবে শারদীয় দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে হিন্দু সম্প্রদায় লক্ষ্মীপূজা উদযাপন করে থাকে।

সনাতন বিশ্বাস মতে, বছরের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাত আশ্বিনের পূর্ণিমা তিথিতে ধনসম্পদ, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী বিষ্ণুলোক থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন পূজা গ্রহণ করতে। তারা বিশ্বাস করেন, লক্ষ্মী দেবী সন্তুষ্ট থাকলে সংসারে অর্থকষ্ট থাকবে না, বাড়বে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য।

বিজয়া দশমীতে দেবী দুর্গার বিসর্জনের চার দিন পর রোববার লক্ষ্মীপূজা উদযাপন করছেন হিন্দুরা। পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার পূজার পূর্ণিমা শুরু হয় শনিবার ভোররাত ৩টা ২৯ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে আর পূর্ণিমা শেষ হবে রোববার রাত ২টা ২৫ মিনিট ৫ সেকেন্ডে।

দেবী লক্ষ্মীকে বরণের জন্য রোববার ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘর সাজানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সন্ধ্যায় পুরোহিত ডেকে মূল পূজা শুরু করার আগে নিজেদের ঘরে আল্পনাসহ, পূজার সরঞ্জাম দিয়ে সাজানোর কাজে ছিল পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

লক্ষ্মীপূজা হিন্দু নারীদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে- এমনটা বলা হয়ে থাকলেও এই পূজার আয়োজনে ঘরের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ থাকে বলে মনে করেন বাংলাদেশ বেতারের সংগীতশিল্পী দেবাশীষ দেব।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অংশগ্রহণের কথা যদি বলা হয়, তাহলে নারী-পুরুষ দুজনেরই ভূমিকা আছে লক্ষ্মীপূজায়। বাড়ির পুরুষরা বাজার সদাই, পূজার উপকরণ প্রস্তুত বা কেনাকাটা যেমন করছে, নারীরা তেমনি ঘরের উপাচারগুলো পালন করছে।”

পূজার সামাজিকতার কথা উল্লেখ করে নিজেই পূজার সন্ধ্যায় বাড়িতে বাড়িতে প্রসাদ, নাড়ু আর খিচুড়ি নিয়ে যান জানিয়ে দেবাশীষ বলেন, “তবে আগে যে একটা উৎসবের আমেজ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনা সবাই লালন করত, হয়তো বা সেটা অনেকটা কমে গেছে।”

সামাজিকতার বিষয়টা খানিকটা হালকা হয়ে যাওয়ার পেছনে কিছু কারণ উল্লেখ করেন তিনি।

“মানুষের ব্যস্ততা, পরিবারের সদস্যদের যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে থাকার মানসিকতার কারণে পারিবারিক এসব উপাচারগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পর্যাপ্ত পরিমাণে নাড়ু-মোয়া বানানোর উপকরণ না পাওয়া বা বানানোতে সাহায্য করার মানুষ না পাওয়াও এর কারণ হতে পারে।”

লক্ষ্মীপূজার আরেকটি বড় আচার হল সারা বাড়ি আল্পনা দিয়ে সাজানো। শাস্ত্রমতে, ধানের শীষের মাধ্যমে আল্পনা আঁকা হয়। সেই সঙ্গে আঁকা হয় দেবী লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। এই ঐতিহ্যও অনেকটাই আড়াল হয়ে যাচ্ছে নগরায়ণের প্রভাবে।

দেবাশীষ বলেন, “লক্ষ্মীপূজায় আগে যেমন বাসাবাড়িতে আলপনা আঁকা হত, এখন সব একতলা-দোতলা বাড়ি ভেঙে হাই রাইজড বিল্ডিং হওয়ার ফলে উঠোন হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে আল্পনা আঁকার মতো একটা ঐতিহ্যও আস্তে-ধীরে জাদুঘরে চলে যাচ্ছে শহুরে এলাকায়।

“আগে মাটির প্রদীপে সারা রাত আলো জ্বলত, এখন মাটির প্রদীপের জায়গা দখল করেছে ইলেক্ট্রিক প্রদীপ। আগে মায়েরা সারারাত জেগে থাকত বা পাঁচালি পড়ত লক্ষ্মী ব্রতের, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এই রাত জাগা বা পাঁচালি পড়ার প্রবণতা একদম কমে গেছে, হতে পারে এটা সময়ের ডিজিটালাইজেশন বা জেনারেশন গ্যাপ।”

বাঙালি হিন্দু নারীদের কাছে লক্ষ্মীপূজার গুরুত্ব তুলে ধরে প্রতিমা বলেন, “প্রত্যেক সনাতনী বধূদের জীবনে লক্ষ্মীপূজার গুরুত্ব অনেক। কারণ প্রত্যেকটি সংসারে নারীরা মা লক্ষ্মীর সমতুল্য। একজন নারী যেমন মা, তেমনই একজন বোন, একজন মেয়ে এবং একজন স্ত্রী্র ভূমিকা পালন করেন। আমরা তাই সেজেগুঁজে, বাড়ি সাজিয়ে পরিপাটি করে রাখি। আর প্রার্থনা করি, মা লক্ষ্মী আমাদের ঘর ধনধান্যে ভরিয়ে রাখুক।”

“লক্ষ্মীপূজা একদমই ঘরোয়া পরিবেশে হয়। বাজার থেকে প্রতিমা নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত একটা অন্য রকম উচ্ছ্বাস থাকে। তারপর উপবাস রেখে সারাদিন লক্ষ্মীকে নিবেদন করার জন্য ফুল, ফল, বেলপাতা, নৈবদ্য সব সাজানো, নতুন কাপড় পরে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদন, অঞ্জলি দিয়ে তারপর উপবাস ভাঙ্গা হয়,” পূজার আচার বললেন প্রতিমা।

সনাতন শাস্ত্র মতে, ভগবান বিষ্ণুর শক্তির উৎস দেবী লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর বাহন পেচা। লক্ষ্মীকে ছয় গুণের অধিকারী বলা হয়ে থাকে। শরৎকালে পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মী হিসাবে পূজা করা হয়, আবার দীপাবলি বা কালি পূজার সময়ও লক্ষ্মীর পূজা করা হয়, তাকে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপূজা বলা হয়।

লক্ষ্মীপূজার উপাদানগুলো হচ্ছে সিঁদুর, ঘট, ধান, মাটি, আমের পাতা বা আম্রপল্লব, ফুল, দুর্বা, তুলসীপাতা, হরীতকী, চন্দন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, আতপ চাল ও জল।

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পূজা নিয়ে চালু আছে নানান গল্প ও বিশ্বাস। মনে করা হয়, লক্ষ্মীপূজায় রাত পর্যন্ত জাগলে সেই বাড়িতে দেবী লক্ষ্মী প্রবেশ করেন। যারা তাকে রাত পর্যন্ত জেগে আরাধনা করেন, দেবী তাদের আশীর্বাদ করেন। হিন্দু বিশ্বাসমতে, লক্ষ্মীর আসার সময় যে বাড়ির গৃহস্থরা ঘুমিয়ে থাকেন, সেখান থেকে মুখ ফেরান দেবী।