দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিকে বাঁচাতে দুই যুবকের লড়াই

“কেউ ভিডিও করছিল, কেউ ফেইসবুকে লাইভ করছিল, কেউবা আফসোস করে চলে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় যুবকটিকে বাঁচানোর তাগিদে রিকশায় তুলে নিই আমরা।”

ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2023, 02:11 PM
Updated : 27 Feb 2023, 02:11 PM

ঘটনাচক্রে একটি দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন ইব্রাহিম তুষার ও কাইয়ুম বিশ্বাস; ট্রেনের ধাক্কায় আহত ব্যক্তিটিকে দেখে বাঁচাতে নেমেছিলেন তারা। দুই হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাতে সফল হয়েছিলেন, ওষুধের ব্যবস্থা করতে মোবাইলও বন্ধক রেখেছিলেন; যদিও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি ওই ব্যক্তিকে।

পেশায় অটোরিকশাচালক কাজল হোসেন (২৮) নামে ওই ব্যক্তি রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার তেজগাঁও রেল ক্রসিংয়ের কাছে একটি ট্রেনের ধাক্কায় আহত হন।

তখন ওই পথ দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন তিতুমীর কলেজের সদ্য মাস্টার্স শেষ করা তুষার ও কাইয়ুম। তেজগাঁও মহিলা কলেজের পাশে একটি মেসে থাকেন তারা। দুজনই এখন বিদেশ যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুষার জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা রিকশায় মেসে ফেরার সময় লেভেল ক্রসিংয়ে দুটি ট্রেন যাওয়ার কারণে আটকা পড়েন। ট্রেন দুটি চলে যাওয়ার পর হৈ চৈ শুনে রেলাইনের কাছে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় একজনকে ছটফট করতে দেখেন।

তুষার বলেন, “এসময় কেউ ভিডিও করছিল, কেউ ফেইসবুকে লাইভ করছিল, আবার কেউবা আফসোস করে চলে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় যুবকটিকে বাঁচানোর তাগিদে রিকশায় তুলে নিই আমরা।”

অচেনা নেই যুবককে নিয়ে প্রথমে ফার্মগেইটের আলরাজী হাসপাতালে হাজির হন তুষার ও কাইয়ুম। সাময়িক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন সেখানকার চিকিৎসকরা।

তুষার বলেন, “তাকে অ্যাম্বুলেন্স নেওয়ার ব্যাপারে অনেক চেষ্টা করি। ৯৯৯ এও রিং দেওয়া হয়। কিন্তু না পেয়ে শেষে সিএনজিতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রওনা হই। পথে তার (আহত ব্যক্তি) অবস্থা গুরুতর দেখে পিজিতে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) সিএনজি নিয়ে ঢুকে পড়ি।”

সেখানেও জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক কিছু সেবা দিয়ে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

আহত এই ব্যক্তির জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স জরুরি, সেটা বুঝতে পারছিলেন তুষার ও কাইয়ুম। কিন্তু তাদের পকেটে টাকা না থাকায় তারা অটোরিকশায় করেই ঢাকা মেডিকেলে রওনা হন।

ঢাকা মেডিকেলে ১০ টাকার টিকেট কেটে জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর চিকিৎসক দেখে ওষুধের একটি তালিকা ধরিয়ে দেন বলে জানান তুষার।

তিনি বলেন, “আমরা জানতাম ঢাকা মেডিকেলে গেলে অন্তত টাকা লাগে না, ফ্রি চিকিৎসা হয়। কিন্তু সেখানেও রক্ত কেনা থেকে শুরু করে ওষুধ সবটাই কিনতে হয়।”

চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ওষুধ কিনতে গিয়ে ধাক্কা খান তুষার।

“তারা ওষুধ ধরিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে বলে। কিন্তু আমাদের পকেট প্রায় খালি। এ অবস্থায় আমার রুমমেট তার মোবাইলটি ওই ওষুধের দোকানে বন্ধক রেখে ওষুধগুলো নিয়ে চিকিৎসকের হাতে তুলে দিই।”

এরপর চিকিৎসকের নানা ধরনের পরামর্শ পালনের মধ্যে মধ্যরাতে রক্তের জন্যও ছোটাছুটি করতে হয়েছিল এই দুই যুবককে। আইসিইউও ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছিল না। মধ্যরাতের পর আইসিইউতে একটি শয্যা খালি হলে সেখানে নেওয়া হয় আহত ব্যক্তিকে। চিকিৎসক কিছুটা আশার বাণী শোনালে কিছুটা হাঁপ ছাড়েন তুষার ও কাইয়ুম।

তবে ভোরে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর খবর শোনার পর মুষড়ে পড়েন তুষার।

“নির্ঘুম সারারাত জেগে ভোরে খোঁজ নেওয়ার সময় চিকিৎসক যখন আশাহতের কথা জানালেন, তখন নিজেকে চরম অপরাধী মনে হয়েছে। আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম একটি লোক কীভাবে মারা গেল, তাকে বাঁচাতে পারলাম না।”

টাকার বন্দোবস্ত না হওয়ায় সোমবার সন্ধ্যা অবধি ওষুধের দোকান থেকে কাইয়ুমের মোবাইল ফোনটিও ছাড়িয়ে আনা যায়নি বলে জানান তুষার।

কাইয়ুম ও তুষার অচেনা হিসেবে ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে প্রাণান্ত লড়াই করলেও পরে তার পরিচয় পাওয়া গেছে।

কমলাপুর রেলওয়ে থানার এসআই সেকেন্দার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ওই যুবকের নাম কাজল। তার বাড়ি ময়মনসিংহে।

আহত যুবকের মোবাইল ফোন সংগ্রহ করে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। ভোরে স্ত্রী, মাসহ পরিবারের সদস্যরা যখন আসেন, ততক্ষণে কাজল মারা গেছেন।

এসআই সেকেন্দার জানান, কাজলের স্ত্রী মমতা বেগম অন্তঃসত্ত্বা।

মমতা বেগম পুলিশকে জানিয়েছেন, রোববার সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ জেলার কোতোয়ালি উপজেলার ঘুন্টি বাজার গ্রামের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি কাজল।

এসআই সেকেন্দার বলেন, কাজল অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি ঢাকায় রিকশাও চালাতেন। পরিবারের আবেদনে ময়নাতদন্ত ছাড়াই কাজলের লাশ হস্তান্তর করেছে রেল পুলিশ।