Published : 01 Jan 2024, 05:51 PM
গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক ঠকানোর মামলায় ছয় মাসের সাজার রায় শোনার পর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস দাবি করেছেন, তিনি দোষ না করেও সাজা পেয়েছেন।
সোমবার রাজধানীর বিজয় নগরের টাপা প্লাজায় ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত রায় ঘোষণার পর বাইরে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “যে দোষ করিনি, সেই দোষের শাস্তি পেলাম। এটাকে ন্যায়বিচার যদি বলতে চান, তাহলে বলতে পারেন।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ইউনূসসহ তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।
এ মামলা বাতিলের আবেদন নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতেও গিয়েছিলেন ইউনূস। কিন্তু গত মে মাসে তার আবেদন আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে গেলে মামলা চালানোর বাধা দূর হয়।
চলতি বছরের ৬ জুন অভিযোগ গঠনের সাত মাসের মাথায় বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।
তিনি ইউনূসের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহানকে শ্রম আইনের ৩০৩ এর ৩ ধারায় ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। অনাদায়ে আরো ১০ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
একই আইনের ৩০৭ ধারায় তাদের সবাইকে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন শেখ মেরিনা সুলতানা।
গ্রামীণ টেলিকমের ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করা, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে। ৮৪ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
সাজা হলেও আপাতত জেলে যেতে হচ্ছে না কাউকে। আপিলের শর্তে তাদের ১ মাসের জামিন দিয়েছেন বিচারক।
ইউনূসের মামলার এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই শ্রম আদালতে উৎসুক মানুষের দৃষ্টি ছিল।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শ্রম আদালত ও আশেপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
রায়ের খবর সংগ্রহ করতে দেশের বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মীর পাশাপাশি বিবিসি, আল জাজিরা, ডয়চে ভেলেসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিও উপস্থিত হন।
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ফরিদা আখতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, আইনজীবী সারাহ হোসেনও রায় দেখতে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
ড. ইউনূস সাজা পেলেও ‘বন্ধুদের’ আদালতে দেখে ভীষণ তৃপ্ত। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে ইংরেজি বছরের প্রথম দিন। সারা দুনিয়া এটি পালন করে বছরের নতুন দিন হিসেবে। আমরা আজকে আদালতে এসেছিলাম রায় শোনার জন্য। এসে মনটা ভরে গেল।
“আমার বহু বন্ধু-বান্ধব এখানে পেয়ে গেলাম। যাদের সঙ্গে আমার বহুদিন দেখা হয়নি। এরা আজকে এসেছে, এই আনন্দের দিনে যে, আমার কী রায় হয়, আমার কী অবস্থা দাঁড়াল, তা দেখার জন্য। আমি কিন্তু খুব খুশি তাদের দেখে।”
ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, তারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আমরা ১০৯টি দ্বিমত দিয়েছি। একটা দিলেই খুনির আসামিও খালাস পেয়ে যায়। অথচ ১০৯টা দিয়েছি, ১০৫টা সাজেশন দিয়েছি, তারপরও এই রায়।
“আসলে ইউনুসকে শায়েস্তা করার জন্য এ রায়।”
মামলা বৃত্তান্ত
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।
এ মামলা বাতিলের আবেদন নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতেও গিয়েছিলেন ইউনূস। কিন্তু গত মে মাসে তার আবেদন আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে গেলে মামলা চালানোর বাধা দূর হয়।
এরপর চলতি বছরের ৬ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা।
গত ২২ অগাস্ট থেকে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বাদীসহ চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ৮ নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেন আসামিরা।
৩৪২ ধারার আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখিত বক্তব্যে ইউনূস বলেছিলেন, শ্রম আইনের ২৩৪ ধারার বিধান লঙ্ঘিত হলে ২৩৬ ধারায় অনেকগুলো প্রতিকারের বিধান রেখেছে। শ্রম আইনের ২৩৬ ধারার উপরোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ না করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বিবাদী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারে না। এটি সম্পূর্ণ আইনের লঙ্ঘন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।আমি নিজের স্বার্থে কোনো কিছু করিনি। আমি অপরাধ করিনি।”
সেদিন শুনানি শেষে ইউনূস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি তো নিজে এ প্রতিষ্ঠানের মালিক নই। আমার আদর্শ কর্মসূচিতে কোনো ত্রুটি ছিল না। এত বড় কাজ করতে গেলে কিছু ভুল হতে পারে। আমরা তো ফেরেশতা নই। কিন্তু ভুল হলে তা ইচ্ছাকৃত নয়।”
কার কী যুক্তি
২৪ ডিসেম্বর চলে দুইপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের আইনি বাহাস। ইতি টানা হয় ১১ কার্যদিবসের শুনানির, যা শুরু হয়েছিল ২১ নভেম্বর।
আদালতে ইউনূসের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। অন্যদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন মো. খুরশীদ আলম খান ও সৈয়দ হায়দার আলী।
ইউনূসের আইনজীবীর দাবি ছিল, ‘হয়রানির জন্যই’ জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজ তৈরি করে মামলা করা হয়েছে। তিনি চার আসামির সবার খালাস চান।
অন্যদিকে ইউনূসসহ আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা চেয়ে যুক্তিতর্ক শেষ করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের আইনজীবী।
ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, “মামলায় যে অপরাধের কথা বলা হচ্ছে, তাতে ইউনূসসহ অন্য আসামিদের সংশ্লিষ্টতার কথা সাক্ষীদের বর্ণনায় আসেনি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো নথিও নেই। মামলার আর্জিতে কোথাও আসামিরা অপরাধী এমন কোনো অভিযোগ উল্লেখ নেই।
“কোম্পানি আইন অনুযায়ী অপরাধ কোম্পানির হবে। কিন্তু এখানে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এ কারণে এ মামলা চলতে পারে না।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হয়াদার আলী সেদিন বলেন, “ডিফেন্সে ব্যাড কনডাক্ট হয়েছে। তারা সাফাই সাক্ষ্য দিয়ে বলতে পারতেন যুক্তিতর্কে যা বলেছেন সেগুলো। তাহলে তাদের কথাগুলো দলিল প্রদশর্নী হিসাবে রায়ে মূল্যায়িত হত। কিন্তু তা তারা করেননি।
“এমনকি তারা আত্মপক্ষ সমর্থন এ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার জবানবন্দিতেও এই সব বিষয়ে মৌখিকভাবে তুলে ধরেননি। আসামিপক্ষ শুধু আমাদের রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তবব্যের বিরোধিতা করে যুক্তি দিয়েছেন যুক্তিতর্কের শুনানির সময়। আমরা আশা করছি, আমাদের পক্ষেই রায় আসবে। অভিযুক্তরা সাজা পাবেন।”
দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ২৪ ডিসেম্বর তিনি এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করে দেন।
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টাকে ‘শান্তি স্থাপন’ বিবেচনা করে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে, যে প্রতিষ্ঠানটির সূচনা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে একটি সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ চেষ্টার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ইউনূস। জরুরি অবস্থার মধ্যে বড় সব দল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখতে বাধ্য হলেও তাকে নতুন দল গঠনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল তখন, যা ছিল ইউনূসের প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ।
এরপর নরওয়ের টেলিভিশনে ২০১০ এর ডিসেম্বরে প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া বিদেশি অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগ ওঠে ইউনূসের বিরুদ্ধে। সেই প্রামাণ্যচিত্র নতুন করে সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে যায় গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসকে। ঋণ দেওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংক গ্রহীতাদের কাছ থেকে যে প্রক্রিয়ায় কিস্তি আদায় করে, তা নিয়েও শুরু হয় নতুন সমালোচনা।
দেশে ও বিদেশে বাম ধারার অনেক বুদ্ধিজীবী দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষুদ্র ঋণের বিরুদ্ধে বলে আসছেন। তাদের মতে, দারিদ্র্য বিমোচনে এই ঋণের ভূমিকা প্রমাণিত নয়। আর গ্রামবাংলায় সুদখোর মহাজনেরা সব সময়ই পরিচিত ছিলেন ‘রক্তচোষা’ হিসেবে। সেই বিবেচনা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে সময় ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “গরিব মানুষের রক্ত চুষে খেলে ধরা খেতে হয়।”
সরকারের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউনূস এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে এলেও ২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ায় তার পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বছর মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ইউনূসকে অব্যাহতি দেয়, তখন তার বয়স প্রায় ৭১।
যেখানে সরকারি চাকরিতে অবসরের সীমা তখন ছিল ৫৭ বছর, অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অবসরের বয়স ছিল ৬০, বিচারকদের ৬৭, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের ৬৫, সেই পরিস্থিতিতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই অব্যাহতির আদেশকে ‘প্রতিহিংসা’ হিসেবে দেখেছিলেন অনেকে।
ইউনূস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যান এবং দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আপিল বিভাগের আদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারান।
এরপরও তাকে পদে রাখার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। ইউনূসের বিষয়টি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনায় পড়তে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে ইউনূসের বক্তিগত বন্ধুত্বের বিষয়টি সব মহলেরই জানা। গ্রামীণ ব্যাংকের পদ নিয়ে আইনি লড়াইয়ের মধ্যেই হিলারি ক্লিনটন এ ব্যাপারে সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়ে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ঝুলে যাওয়ার পেছনেও ইউনূসের হাত রয়েছে। ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী বন্ধুদের তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লাগিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
ইউনূস সব সময়ই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।