রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রধানমন্ত্রীর ৫ প্রস্তাব

রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ যেন না ঘুরে যায়, সেই আহ্বান রেখেছেন শেখ হাসিনা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2022, 03:46 PM
Updated : 22 Sept 2022, 03:46 PM

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে এই জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়াসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক সফররত প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার লোটে প্যালেস হোটেলে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এই পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।

প্রস্তাবে রয়েছে

  • রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান;

  • আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়াকে সমর্থন করাসহ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং জাতীয় আদালতের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়তা করা;

  • জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা;

  • আসিয়ানের পাঁচ-দফা ঐক্যমত মেনে চলার অঙ্গীকার পূরণে মিয়ানমারকে দৃঢ়ভাবে আহ্বান জানানো;

  • মিয়ানমার যাতে বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকারে রাজি হয় সেজন্য উদ্যোগ নেওয়া।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “গত মাসে আমরা দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটের ষষ্ঠ বছরে পা দিয়েছি, তাদের একজনকেও তাদের ঘরে ফিরে যেতে দেখিনি।”

মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাসে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আরাকানে, বর্তমানে যা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য হিসেবে পরিচিত, অষ্টম শতক থেকেই রোহিঙ্গারা বসবাস করে আসছে।

“১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জনের পর সেখানে নতুন সরকার রোহিঙ্গাদের ‘টার্গেট’ করে এবং তাদের ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর ১৯৮২ সালে সেখানে নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস হয় এবং জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদেরকে তাতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অথচ ১৯৫২ সালে যখন ইউ নু প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখনও তার মন্ত্রিসভায় দুইজন রোহিঙ্গা মন্ত্রী এবং তখনকার পার্লামেন্টে ছয়জন রোহিঙ্গা এমপি ছিলেন।”

মিয়ানমারের ওইসব রোহিঙ্গা মন্ত্রী ও এমপিদের নাম উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এ থেকে প্রমাণ হয় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক।”

“বর্তমান সংকটের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারে এবং তার সমাধানও সেখানেই রয়েছে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়া এবং প্রতিবছর শরণার্থী শিবিরে ৩০ হাজার নবজাতকের জন্ম নেওয়ার তথ্যও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয়ভাবে তাদের শক্তিশালী মানবিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞ। নিজ দেশে একটি ভালো এবং নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষায় থাকার এই সময়ে রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সংহতি প্রয়োজন।”

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই বাংলাদেশ আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়ে আসছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের পর ২০১৭ সালে দুই দেশ তিনটি চুক্তি সই করেছে। প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুইবার প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু রাখাইনে অনুকূল পরিবেশের অভাবে বাছাই করা রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হয়নি।

“তাদের নিরাপত্তা, সহিংসতার পুনরাবৃত্তি না হওয়া, জীবিকার সুযোগ এবং নাগরিকত্ব লাভের পথসহ মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল।”

তিনি বলেন, “মিয়ানমারের তার বাধ্যবাধকতা অব্যাহতভাবে অমান্য করে চলার পটভূমিতে, বাংলাদেশ একটি ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চীনের সহায়তায় প্রত্যাবাসন আলোচনা শুরুর জন্য বিকল্প পথ নেয়। সেপথেও আজ পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি হয়নি।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বাস্তবতা হচ্ছে, কক্সবাজারে এখন বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির অবস্থিত, মাত্রার দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম বড় মানবিক সংকট সহায়তা কার্যক্রমের একটি এটা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সেবা পাচ্ছে।”

বাংলাদেশ তার জাতীয় কোভিড টিকাদান কর্মসূচিতেও রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করেছে জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, “তারা মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে মিয়ানমারের ভাষা শেখার সুবিধা, দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রমে যোগদান এবং জীবিকার সুযোগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। এগুলো তাদের সংস্কৃতি এবং ভাষা ধরে রাখতে অবদান রাখছে এবং যা শেষ পর্যন্ত তাদের ফিরে যাওয়ার পরে নিজ সমাজে আবার যুক্ত হতে সাহায্য করবে।”

শেখ হাসিনা জানান, “প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে অস্থায়ীভাবে স্থানান্তরের জন্য আমরা আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে ৩৫০ মিলিয়ন (৩৫ কোটি) ডলার ব্যয় করে ভাসানচর নামে একটি স্থিতিশীল দ্বীপের উন্নয়ন করেছি এবং সেখানে এ পর্যন্ত প্রায় ৩১ হাজার রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় স্থানান্তর হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান আমাদের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ১ দশমিক ২ মিলিয়ন (১২ লাখ) রোহিঙ্গাকে আতিথেয়তা দেওয়ার চাপ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতি বছর আমাদের প্রায় ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন (১২২ কোটি) ডলার ব্যয় করতে হয়।

“(এছাড়া) জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, প্রায় ৬ হাজার ৫০০ একর বনভূমির ক্ষতি এবং স্থানীয় জনগণের ওপর এর বিরূপ প্রভাব অপরিমেয়। সামাজিক ও জনসংখ্যাগত ভারসাম্য, দেশীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ (অতিরিক্ত) ভার বহন করছে।”

তিনি বলেন, “বিশ্ব এখন নতুন নতুন সংঘাত প্রত্যক্ষ করছে এবং দুর্ভাগ্যবশত রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে মনোযোগ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে - এর রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকটের চাহিদা মেটানো - উভয়ক্ষেত্রেই।”

প্রধানমন্ত্রী জানান, “২০২২ সালের অগাস্ট পর্যন্ত, জেআপি ২০২২-এর অধীনে ৮৮১ মিলিয়ন (৮৮ কোটি ১০ লাখ) ডলার সহায়তা চাওয়া হলেও মাত্র ৪৮ শতাংশ অর্থায়ন করা হয়েছে। একই সময়ে, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ সংঘাতের বিরূপ প্রভাব আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করছে, কারণ এটি তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার সম্ভাবনার জন্য আরও বাধা তৈরি করতে পারে।”

টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বাস্তব পদক্ষেপ এবং প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে বলেও মত দেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “একটি আঞ্চলিক সংস্থা হিসাবে আসিয়ান এবং এই জোটের স্বতন্ত্র সদস্য দেশগুলো মায়ানমারের সঙ্গে তাদের গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের একটি সমন্বিত সংযোগ সৃষ্টিতে নেতৃত্বদানকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

“রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব অর্জনের পথ তৈরির মূল বিষয়সহ রাখাইন রাজ্যে কফি আনান উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নে তাদের বিস্তৃত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত। বেসামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের অর্থবহ উপস্থিতি স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের আস্থা বাড়াবে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ মিয়ানমারকে (বাধ্যবাধকতা মানতে) বাধ্য করতে পারে না। সংকট সমাধানে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি মিয়ানমারের স্বার্থকেই এগিয়ে নিচ্ছে।

“বাংলাদেশ মনে করে, রোহিঙ্গা সংকটের একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান এবং রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ আস্থা-নির্মাণ ব্যবস্থা খুঁজে পেতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি জরুরি হবে।”

বাংলাদেশ ন্যায়বিচার থেকে দায়মুক্তির বিরুদ্ধে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যে কোনো উদ্যোগকে সমর্থন করবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ এবং আসিয়ানের বর্তমান মনোযোগ মিয়ানমারে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা হলেও, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে; এবং মিয়ানমারের জনগণের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার আনতে তাদের শক্তিশালী ভূমিকার অপেক্ষায় রয়েছে।”