Published : 25 Jul 2024, 01:32 AM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি থেকে ছয় বছরের রিয়া গোপকে নিয়ে আসেন তারা বাবা দীপক কুমার গোপ।
মাথায় গুলিবিদ্ধ একমাত্র সন্তানকে নিয়ে শুক্রবার প্রথমে জরুরি বিভাগে ও পরে নিউরোর জরুরি বিভাগে ছুটে যান দীপক কুমার। সেখানে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনা কাভার করার সময় ছররা গুলিবিদ্ধ এক সাংবাদিকও চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
রিয়া গোপকে বেডে শুইয়ে দিয়ে তার মাথার ব্যান্ডেজ খোলামাত্রই ক্ষতস্থান দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন কর্তব্যরত চিকিৎসকই।
স্থানীয় কোনো ওষুধের দোকান থেকে রিয়ার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়েছিল। তার মাথার পেছনে গুলি লাগে। চিকিৎসকরা প্রথমে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেন। মাথায় ভালোভাবে ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করতে করতেই চিকিৎসকরা দীপক কুমারকে ডেকে বললেন তার মেয়ের জন্য রক্ত লাগবে।
তখন এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ঢাকা মেডিকেলের নিউরোর জরুরি বিভাগের ওয়ার্ডে।
শিশুটির বাবা-মা চিকিৎসকদের পা ধরে রিয়াকে বাঁচানোর অনুরোধ করতে থাকেন। শিশুটির রক্তের গ্রুপ জানা ছিল না। তার বাবা দীপক কুমারকে একটি সিরিঞ্জে রক্ত টেনে গ্রুপ পরীক্ষা করতে পাঠান চিকিৎসকেরা। তখন তার মা অসহায়ের মত হাসপাতালের বারান্দায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্বজনদের ফোন করে আসতে বলছিলেন।
সেদিন দীপক কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, তাদের সঙ্গে ছাদে কাপড় তুলতে গিয়েছিল রিয়া। সেখানে হঠাৎ গুলি এসে লাগে, পড়ে যায় রিয়া। এরপর রক্তে ভাসাভাসি, চারদিকে তখন যুদ্ধ পরিস্থিতি। তাকে নিয়ে কোনো রকমে রিকশা-সিএনজি করে ঢাকা মেডিকেলে আসেন তারা।
নিউরোর জরুরি বিভাগ থেকে রিয়াকে পরে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার সকাল ১০টায় তার মৃত্যু হয়।
ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অনেক ট্রাই করেছি। ছোট্ট একটা বাচ্চা, মাথায় গুলি লেগেছিল। পরে তাকে পেডিয়াট্রিক আইসিইউতে দেওয়া হয়েছিল। তবে আমরা তাকে সেইভ করতে পারিনি।”
শুধু রিয়া নয়, তার মত একই দিন শুক্রবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সংঘাতের সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মুসা খান নামের ছয় বছরের আরেক শিশুকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
মুসা খানের বাসা রামপুরার বনশ্রী এলাকায় যেখানে বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত আন্দোলনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।
ওই সংঘর্ষের মধ্যে শুক্রবার মাথায় গুলি লাগে ছয় বছরের মুসা খানের। সম্পর্কে তার দাদি খালেদা আক্তার শুক্রবার নিউরোর জরুরি বিভাগের (৯৮ নম্বর) সামনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসার গ্যারেজে থাকা অবস্থায় বাচ্চাটার মাথায় গুলি লাগে। তার বাবা মোটরসাইকেল রাখছিল। এসময় গ্যারেজের কেচি (কলাপসিবল) গেইটও বন্ধ আছিল। ওই সময় আইসা গুলি লাগে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীসহ দেশজুড়ে সহিংসতা শুরু হয় ১৫ জুলাই। পরদিন থেকে আসে প্রাণহানির খবর। শনিবার পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় দুইশ জনের নিহতের খবর রয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আনার পর বা আনার পর সেখানে মৃত ঘোষণা করা হয়।
কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই আন্দোলন চালিয়ে আসছিল শিক্ষার্থীরা। তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির পর সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করলে আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়।
এ অবস্থায় শুক্রবার মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। সেই সঙ্গে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, ছাত্রদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত এসব নাশকতা ঘটিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের পতন ঘটানো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে লাশ নিতে আসা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সহিংসতার মধ্যে আহাদ (৪), হোসাইন (১০), মোবারক (১৩), ইব্রাহিম (১৩), ইফতি (১৬) এর মৃত্যু হয়। আর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিয়া গোপ।
এর বাইরে মিরপুরে ১১ বছরের সাফকাত সামির মৃত্যু হয়। স্থানীয় হাসপাতালে মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যরা কাফরুল থানা পুলিশের অনুমতি নিয়ে লাশ দাফন করে।
এদের স্বজনরা বলছেন, নিহতদের মধ্যে কেউ নিজের ঘরে, কেউ ছাদে আবার কেউবা বাসার নিচতলার গ্যারেজে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়।
নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ ছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগের ৪ বছরের আহাদ, গ্রিনরোডের ১৩ বছরের দুধ বিক্রেতা মোবারক, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডের ১৩ বছরের মাদ্রাসাছাত্র ইব্রাহিম, যাত্রাবাড়ীর চিটাগাং রোড এলাকায় ১০ বছরের হোসাইন গুলিতে মারা যান।
অপরদিকে ঢাকার মিরপুরে ঘরের মধ্যে জানালা দিয়ে গুলি আসা গুলিতে বিদ্ধ হয়ে ১১ বছরের সাফকাত সামি মারা যান।
গত ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর চিটাগাং রোড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় হোসাইন। জুমার নামাজের পর বাসা থেকে বের হয়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হয় সে। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুদিন পর ২১ জুলাই তার লাশ নিতে ঢাকা মেডিকেল মর্গে এসেছিল হোসাইনের বাবা-মা। তার বাবা মানিক মিয়া ফুটপাথে আচার বিক্রি করেন, মা মালেকা বেগম পোশাক কারখানার কর্মী।
সেদিন মালেকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “আমি দুপুরে পুতেরে ভাত খাওয়াইয়া, প্যান্ট-গেঞ্জি পরাইয়া দিছি। কিছুক্ষণ পর ও বাসা থিকা বাইর হইল। এরপর বিকালে আর বিচরায়া পাই না। মাইনষে মোবাইলে ছবি দেখাইয়া কয়, এইটা কী আপনে গো পুত। ঢাকা মেডিকেলে আইসা দেখি পুতে আমার মইরা গ্যাছে গা।”
যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় ৪ বছরের আহাদ গত ১৯ জুলাই বাবা-মায়ের সঙ্গে আটতলা বাসার ছাদে উঠেছিল পরিস্থিতি দেখতে। সেখানেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে।
রোববার আহাদের বাবা সরকারের রাজস্ব বিভাগের চাকুরে আবুল হোসেন এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল মর্গে সন্তানের লাশ নিতে।
আহাদের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে রাখতে রাখতে বিলাপ করছিলেন, ডাকছিলেন সৃষ্টিকর্তাকে। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে। আবুল হোসেন বলেন, তিন দিন ধরে কাঁদছেন তারা।
মাদ্রাসা ছাত্র ইব্রাহিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায়।
তার বড় ভাই মো. সাগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইব্রাহিম এইখানকার একটা মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ে। বৃহস্পতিবার ওদের মাদ্রাসা ছুটি হয়, তখন ও বাড়িতে চলে আসে। শুক্রবার বাড়িতেই আছিল।
“জুমার নামাজের পর পাঞ্জাবিটা খুইলা বন্ধু-বান্ধব গো সাথে বাইর হয়। এরপর বিকালে আমাগো কাছে ফোন আসে ইব্রাহিম নাকি গুলি খাইছে, ওরে ঢাকা মেডিকেলে পাঠাইছে। এরপর আমি গিয়া মর্গে লাশ খুঁইজা বাইর করছি, ওর মাথার পিছনে গুলি লাগছিল।”
সাফকাত সামির বাবা-মায়ের সঙ্গে মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায় একটি ভবনের দোতলায় থাকতেন। বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে গুলি এসে তার চোখ ভেদ করে মাথা ফুড়ে বেরিয়ে যায়।
কাফরুল থানায় বিনা ময়নাতদন্তে লাশ পাওয়ার আবেদন দিয়ে লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যায় সামিরের পরিবার। তার বাবা সাকিবুর রহমান বেসরকারি চাকরি করেন।
১৩ বছরের মোবারক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ঢাকার গ্রিনরোড এলাকায়। তার বাবা রমজান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গাভী পালি, কাঁঠালবাগান এলাকায় আমাদের ফার্ম আছে। আমার ছেলেটা বাড়ি বাড়ি গিয়া দুধ দিয়ে আসত।
“দুধ দিয়া আসতে গিয়া শুক্রবার গ্রিনরোড এলাকায় মাথায় গুলি লাগে তার। সে ওইখানে পইড়া ছিল। এলাকার লোকজন আমাদের চেনে, তারা আমাকে জানায় ছেলের মাথায় গুলি লাগছে; গ্রিনলাইফ হাসপাতালে ভর্তি। গিয়া দেখি আইসিইউতে ভর্তি। তারপর মারা যায়।”
এছাড়া রামপুরার বনশ্রীর পাশে মেরাদিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইফতি নামে ১৬ বছরের এক ওয়ার্কশপ কর্মী কিশোর।
মেরাদিয়ার একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার গ্যারেজে কাজ করতেন ইফতি। গত শুক্রবার দুপুরে বন্ধু-বান্ধবরা তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়।
ইফতির মা মিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “পরে ওর বাপের কাছে ফোন কইরা কইছে, ওরে গুলি লাগছে। আমরা রিকশায় কইরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়া আসছি, ডাক্তার কইছে মইরা গ্যাছে গা।”
মিনা সেদিন বলেছিলেন, “আমার দুইডা মাইয়ার পর একটাই পোলা। আল্লাহ ওরে নিয়া গেল।”
সংঘাতে দেখা গেছে শিশুদেরও
সংঘাতের সময় মহাখালী, রামপুরা, বাড্ডা এলাকায় শিশুদের লাঠিসোঁটা নিয়ে ভাঙচুর করতে ও ঢিল ছুঁড়তে দেখেছেন অনেকে।
গত ১৮ জুলাই বিকালে মহাখালীর দুর্যোগ ভবনের সামনে রাখা গাড়িগুলো ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় একদল দাঙ্গাকারী। সেই দলটিতে হাফপ্যান্ট পরা কয়েকটি শিশুকেও দেখা যায়। হাতে লাঠি নিয়ে গাড়ির কাচে আঘাত করে ভাঙচুরের চেষ্টা করছিল তারা। এই শিশুরা কারা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।