১১৬১ কোটি টাকা ‘গচ্চায়’ বিমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2023, 07:28 PM
Updated : 6 Feb 2023, 07:28 PM

মিশর থেকে ভাড়ায় দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ এনে রাষ্ট্রের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ‘গচ্চা যাওয়ার’ পেছনে বিমান কর্মকর্তাদের দুরভিসন্ধি খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।

এ নিয়ে বিমানের ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে সোমবার দুদকের ঢাকা কার্যালয়-১ এ মামলা করেছেন সংস্থাটির উপপরিচালক জেসমিন আক্তার।

দুদক বলছে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য কর্মকর্তারা আরও ভালো উড়োজাহাজ রেখে নষ্ট ও বসে থাকা দুটি উড়োজাহাজ পাঁচ বছরের জন্য ভাড়ায় এনে এক বছরও চালাতে পারেনি। উল্টো বসিয়ে বসিয়ে সেগুলোর মেরামত খরচ ও ভাড়া গুনতে হয়েছে।

মামলায় যে ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে, তার মধ্যে ১০ জন ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন। তারা হলেন- বিমানের সাবেক ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ (৬২), সাবেক ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আলম সিদ্দিক (৬৩), সাবেক মুখ্য প্রকৌশলী শহীদ উদ্দিন মোহাম্মদ হানিফ (৫৫), আরেক সাবেক মুখ্য প্রকৌশলী দেবেশ চৌধুরী (৬৩), সাবেক ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম শামিম (৬৫), সাবেক চিফ পার্সার কাজী মোসাদ্দেক আলী (৬৫), সাবেক ব্যবস্থাপক আব্দুল কাদির (৫৭), সাবেক উপপ্রধান প্রকৌশলী মো. শাহজাহান (৬৩), সাবেক ইঞ্জিনিয়ার অফিসার জাহিদ হোসেন (৫৭) ও সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গাজী মাহমুদ ইকবাল(৫৯)।

বর্তমানে কর্মরত ১৩ আসামি হলেন- মহাব্যবস্থাপক আবদুর রহমান ফারুকী (৫৫), প্রকৌশলী সাদেকুল ইসলাম ভূঞা (৫১), ডিজিএম কামাল উদ্দিন আহমেদ (৫২), প্রধান প্রকৌশলী এ আর এম কায়সার জামান (৫৬), মুখ্য প্রকৌশলী শরীফ রুহুল কুদ্দুস (৫৩), ডিজিএম জিয়া আহমেদ (৪৯), ফ্লাইট পার্সার শহিদুল্লাহ কায়সার ডিউক (৫০), ডিজিএম আজাদ রহমান (৫৭), সহকারী ব্যবস্থাপক ফজলুল হক বসুনিয়া (৫৭), ব্যবস্থাপক আতাউর রহমান (৫১), চিফ পার্সার সাজ্জাদ উল হক শাহিন (৬৫), ফ্লাইট পার্সার শাহনাজ বেগম ঝর্ণা (৫০) ও সিভিল এভিয়েশনের কনসালট্যান্ট গোলাম সারওয়ার (৭৩)।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, এই কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটো এয়ারক্রাফট লিজ আনেন। পরে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেওয়া পর্যন্ত তারা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মোট এক হাজার একশ ৬১ টাকার ‘ক্ষতিসাধন পূর্বক আত্মসাৎ’ করেছেন।

এজাহারে বলা হয়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিমান দরপত্র আহ্বানের পর চারটি কোম্পানি তাতে অংশ নেয়। এরপর টেকনিক্যাল ফিনান্সিয়াল সাবকমিটি ইজিপ্ট এয়ারকে উড়োজাহাজ সরবরাহের জন্য নির্ধারণ করে। উড়োজাহাজের কনফিগারেশনে দেখা যায় ইজিপ্ট এয়ারের বোয়িং দুটির ইঞ্জিন ছিল প্যাট অ্যান্ড হুইটনি কোম্পানির, এগুলো অনেক পুরোনো এবং দুর্বল- যার স্পেয়ার পার্টস পাওয়া খুব কঠিন। এগুলো চালু ছিল না, সাত মাস ধরে গুদামে বসা অবস্থায় ছিল।

অন্যদিকে তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা স্ট্যান্ডার চার্টার্ড কোম্পানির বোয়িং দুটোর ইঞ্জিন ছিল রোলস রয়েসের তৈরি। এগুলো তখন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে চলছিল। এখানে ‘নেগোসিয়েশনের’ সুযোগ ছিল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, ইজিপ্ট এয়ারের উড়োজাহাজ দুটো দেখতে কর্মকর্তাদের দল দফায় দফায় মিশরে যান। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, উড়োজাহাজ দুটোর মেরামত কাজ বাকি আছে। নিয়ম অনুযায়ী, রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বাকি থাকলে এয়ারক্রাফট তার উড্ডয়ন যোগ্যতা হারায়। এর কী কী কাজ বাকি আছে তা পরিদর্শন টিম অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি।

আরেকটি দলের প্রতিবেদনে ইঞ্জিনে তেল ক্ষরণের কথা উল্লেখ করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী, ইঞ্জিনের কমপক্ষে চার হাজার সাইকেল অবশিষ্ট থাকতে হবে। অথচ একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের তিন হাজার ৬১৫ সাইকেল অবশিষ্ট ছিলো, আরেকটির ২১০০ সাইকেল অবশিষ্ট ছিল। এমনকি সেখানে ইজিপ্ট এয়ার কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজ দুটির রক্ষণাবেক্ষণের নথি বাংলাদেশ বিমান কর্মকর্তাদের দেখাতে পারেননি।

এত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও ইজিপ্ট থেকে উড়োজাহাজ ভাড়ার পক্ষে বিমান কর্মকর্তারা মত দেন। অসৎ উদ্দেশ্যে বেশিরভাগ জরুরি কম্পোনেন্টগুলো বুঝে নেওয়ার সময় যাচাই করা হবে বলে কর্মকর্তারা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদক মামলায় বলছে, কোনো উড়োজাহাজকে উড্ডয়নযোগ্য রাখতে সি-চেক অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ইজিপ্ট এয়ারের বোয়িংগুলোর সি-চেক মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। যেই দল উড়োজাহাজ দুটি বুঝে নিয়েছেন, তারা অসৎ উদ্দেশ্যে ত্রুটিপূর্ণ ও মেরামত অযোগ্য উড়োজাহাজকে বহরে যুক্ত করার পক্ষে মত দেন। উড়োজাহাজ দুইটি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেওয়া হলেও মাত্র ১১ মাসের মাথায় উড়োজাহাজ দুটির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়।

উড়োজাহাজ দুটি সচল রাখার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকে আরও চারটি ইঞ্জিন লিজ নেওয়া হয় এবং সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। অসৎ উদ্দেশ্য ও দুর্বল চুক্তির কারণে ফেরত দিতে না পারায় লিজের পুরো সময় সম্পন্ন করে ২০১৯ সালের শেষে উড়োজাহাজগুলো ফেরত দেওয়া হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার বিষয়ে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন বলছেন, “আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে টেন্ডার প্রক্রিয়াতে অনিয়ম দেখা গেছে। যদি কর্মাশিয়াল সেটেলমেন্টের মাধ্যমে উড়োজাহাজগুলো ফেরত দেয়া যেত তাহলে ক্ষয়-ক্ষতি এড়ানো যেত।”

আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে সচিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন- তারা পালিয়ে যেতে বা দেশত্যাগ করতে পারেন অথবা অন্য কোনো কারণে তাদের গ্রেপ্তার জরুরি মনে করলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেন। বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার ওপর নির্ভর করবে।”

জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম বলেন, “আমিও গণমাধ্যমের খবরে মামলার বিষয়টি দেখেছি। দুদক থেকে আমরা অফিসিয়ালি জানতে পারলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”

অবশ্য বিমান নিজে থেকে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো বিমানের কর্মকর্তারা বিষয়টিকে যৌক্তিক বলার চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন সময়।

তবে গত ১ জুন বিমানের এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বিমানের পদক্ষেপ জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা, জবাবে বিমানের পরিচালক (প্ল্যানিং অ্যান্ড ট্রেনিং) এয়ার কমোডর মো. মাহবুব জাহান খান বলেছিলেন, “বিমান এখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এটা সবচেয়ে বড় কথা।

“এই ঘটনার পর বিমানের একটি লিজ গাইডলাইন হয়েছে। ভবিষ্যতে উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে কতগুলো সভা হবে, বোর্ডে কতবার উপস্থাপন করতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয়েছে।”

জিএমএ/আরআর

উড়োজাহাজ লিজ: লোকসান থেকে ‘শিক্ষা নিয়েছে’ বিমান