ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধারের ২৪ ঘণ্টা পর তাদের পরিচয় জানাতে পেরেছে পুলিশ।
Published : 25 Sep 2014, 05:08 PM
এরা হলেন- সাজু আহমেদ (৩৫), তার স্ত্রী রাজিয়া বেগম (২৬), তাদের ছেলে ইমরান (৫) ও মেয়ে সানজিদা (৩)। তাদের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের টেপ্রিগঞ্জ ইউনিয়নের গাজকাটি গ্রামে।
বুধবার সকালে কদমপুর এলাকার ছয়তলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে তাদের হাত-পা চোখ বাঁধা লাশ পাওয়া যায়।
কেরানীগঞ্জের এএসপি কাজী মসকুরা লিমা সাংবাদিকদের জানান, ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সোহেল এবং বাসা ভাড়া নিতে সহযোগিতা করা আক্কাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিহতদের পরিচয় জানতে পারেন তারা।
“আমাদের মনে হচ্ছে সাজু কোনো ডাকাত দলের সঙ্গে জড়িত ছিল। এ কারণে কিছু দিন পরপর বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে গোপনীয়তার সঙ্গে চলত।”
ডাকাত দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকেই সাজুর পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি জামাল উদ্দিন জানান, বাসার কেয়ারটেকার সোহেলের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওই বাসায় গিয়ে তারা চৌকির নিচে চারজনের লাশ পান।
এর মধ্যে সাজুর হাত-পা ও মুখ বাঁধা নগ্ন লাশ ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল। তার পাশেই ছিল দুই ছেলে মেয়ের লাশ। আর রাজিয়ার পা বাঁধা লাশ ছিল কম্বল দিয়ে মোড়ানো।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রতিবেশীরা এই পরিবার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দিতে না পারায় বুধবার তাদের পরিচয়ই জানাতে পারেনি পুলিশ।
ওসি জানান, ওই বাসা থেকে তারা একটি ভাঙা মোবাইল ফোন সেট, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স, একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং সরু করে মোড়ানো দুটি টাকার নোট জব্দ করেন, যেগুলো ইয়াবা বা হেরোইন সেবনে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তাদের ধারণা।
ড্রাইভিং লাইসেন্সে সাজুর নাম থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিতে মোমিনুল ইসলাম নামে আরেকজনের নাম থাকায় নিহত ব্যক্তি কোন জন- সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছিল না পুলিশ।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপ পরিদর্শক এ কে আজাদ বলেন, “কয়েক মাস আগেও সাজু কেরানীগঞ্জের জৈনপুর এলাকায় একটা টিনশেডের বাসায় থাকত। সেখানকার ভাড়া ১ হাজার টাকার বেশি হবে না। হঠাৎ করেই কিভাবে সে ৫ হাজার টাকা দামের বাসা ভাড়া নিল সেটা পুলিশকে অবাক করেছে। বাসা থেকে পাওয়া ইয়াবা বা হেরোইন সেবনের সরঞ্জামও পুলিশের সন্দেহে রয়েছে।”
এএসপি কাজী মাকসুদা লিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “অপরাধীদের কোনো গুরুতর অপরাধ জেনে ফেলেছিল সাজু। সেটি প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এ কারণেও তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।”
অপরাধ করে পাওয়া সম্পদের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সাজুকে হত্যা করা হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।
রাতে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের ভাই বশির উদ্দিন। ময়নাতদন্ত শেষে লাশগুলো বুঝে নেন তিনি।
“সোহেল জানায়, ৫ হাজার টাকায় এক কাঁচামাল ব্যবসায়ীকে ওই বাসা ভাড়া দেয়া হয়েছিল। আর তাকে বাসা ভাড়া নিতে সহযোগিতা করেছে রফিক ও আক্কাস নামের দুই অটোরিকশা চালক।”
এরপর আক্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে এবং সোহেলকে গোয়েন্দা পুলিশে সোপর্দ করেন বলে বাবুল দেওয়ান জানান।
যে ঘরে লাশগুলো ছিল, সেখানে তোষক বালিশ এলোমেলোভাবে ছড়ানো ছিল। বাসার অন্য একটি শোয়ার ঘর, ড্রইং কাম ডায়নিং ও রান্নাঘরের অবস্থাও ছিল একইরকম।
বাসার কোনো ঘরেই কোনো বাল্ব বা ফ্যান ছিল না। রান্না ঘরের চুলার জায়গায় দেখা যায় একটি কেরোসিনের স্টোভ। হাড়ি-পাতিলের সংখ্যাও একটি পরিবারের প্রয়োজনের তুলনায় কম।
ড্রইং রুমে একটি কাঠের আলনা থাকলেও সেটি ছিল খালি। ওই ঘরে একটি কাঠের চেয়ারও ছিল।
পাশের বাসার বাসিন্দা পাপিয়া আক্তার জানান, বেশিরভাগ সময়ই ওই বাসা তালাবন্ধ থাকত। দুই মাস আগে নতুন ভাড়াটে আসার কথা শুনলেও কখনো কারো সঙ্গে তার কথা হয়নি।
ছয় তলা ওই ভবনের মালিক শামসুল আলম সৌদি আরবে থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সোহেলই ভাড়াটেদের বিষয়ে দেখভাল করতেন।
যেভাবে সনাক্ত
জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের সূত্র ধরে পরিচয় মিলেছে সাজু ও তার পরিবারের।
নিহতের খালাত ভাই মোস্তাকীম ইসলাম ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে এসে তার ভাইয়ের লাশ কিভাবে সনাক্ত করলেন তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
পেশায় রাজমিস্ত্রী মোস্তাকীম থাকেন মিরপুরে। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জেনে শেষবারের মতো দেখতে মর্গে এসেছিলেন তিনি।
মোস্তাকীম বলেন, “বুধবার সন্ধ্যার পর বিভিন্ন খবরে কইসে কেরানীগঞ্জে কারা জানি চারজনরে মাইরা ফেলসে। শুইনা ঠাণ্ডা হইয়া গেসিলাম। মনে মনে কইসি আল্লাহ মাইনসের মনে রহম দাও।”
রাতে মোস্তাকীমের স্ত্রী পঞ্চগড়ের বাসিন্দা চম্পার মোবাইলেই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা থেকে ফোন দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, মমিনুল ইসলাম নামের কাউকে তিনি চিনেন কিনা।
উত্তরে চম্পা বলেছিলেন, সে তার স্বামীর মামাত ভাই। নীলফামারী জেলার ডোমার থানায় থাকেন। রিকসা চালান।
এরপর সাজু আহমেদের কথা জানতে চাইলে চম্পা জানিয়েছিলেন, এই ব্যক্তি তার স্বামীর খালাত ভাই।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপ পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে সেই বাসা থেকে পাওয়া কয়েকশ পরিচয়পত্রের (ভিজিটিং কার্ড) পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো জোড়া লাগিয়ে পুলিশ রাতে বিভিন্ন লোকজনকে ফোন দিতে শুরু করে। সেই সূত্রেই পরিচয় মেলে লাশের।”
চম্পা সাজুর বড় ভাই বশিরকে খবর দিলে রাতেই পঞ্চগড় থেকে তিনি ভাইয়ের লাশ সনাক্ত করতে ঢাকায় রওনা হন।
হাসপাতালের মর্গ থেকে ভাইয়ের লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যানচালক বশির উদ্দিন জানান, পরিবারের সিদ্ধান্তে প্রায় এক দশক আগে বিয়ে করেছিলেন রাজিয়াকে। তাদের দুই সন্তান ইমরান ও সানজিদা।
পুলিশ জানতে পেরেছে, সাজু এক সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রিকসা চালাতেন। পরে ট্রাকের হেলপারের কাজ করে কিছুদিন। তিন বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স করে ট্রাক চালাতে শুরু করেছিলেন।
গ্রামবাসীও অন্ধকারে
স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার সাজুর বাড়ি দেবীগঞ্জের টেপ্রিগঞ্জ ইউনিয়নের গাজকাটি গ্রামে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আকস্মিক এ ঘটনায় সাজুর বৃদ্ধ মাসহ পরিবারের সদস্যরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
সাজুর বড় ভাইয়ের মেয়ে নুরিনা (২৩) সাংবাদিকদের বলেন, ছেলে, বৌমা ও নাতি-নাতনির হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে তার দাদি শুধু কাঁদছেন।
গ্রামবাসী জানায়, এলাকায় দিনমজুরির কাজ করতেন। সাজু ভাগ্য ফেরাতে পরিবারসহ সাত-আট বছর আগে চলে যান ঢাকায়। বছরে এক-দুইবার গ্রামে এসে থাকতেন। দুই মাস আগেও গ্রামে এসেছিলেন তিনি।
সাজু ঢাকায় কী কাজ করতেন, তা স্পষ্ট ছিল না গ্রামের লোকজন বা পরিবারের কাছে। সবাই জানত ঢাকায় তিনি গাড়ি চালাতেন।
ঢাকায় যাওয়ার পর সাজুর আচার-আচরণে পরিবর্তন আসে বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল গফফার শাহ।
কয়েকজন গ্রামবাসী বলেন, এই সময় সাজুর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলা দেখা যায়। তাছাড়া তিনি মাদক সেবনও শুরু করেন।
ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, “কারা, কী কারণে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাল, তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না।কারণ আমার জানা মতে, গ্রামে তার সঙ্গে কারো শত্রুতা ছিল না।”