দ্বিতীয় দফা যুক্তিতর্ক শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধের মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে ট্রাইব্যুনাল।
Published : 24 Mar 2014, 03:17 PM
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এই আদেশ দেয়।
এসব ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ২৮ মে জামায়াত আমিরের বিচার শুরু হয়।
নিজামীর মামলাটি গত ১৩ নভেম্বর রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের নতুন প্রধান দায়িত্ব নেয়ার পর পুনরায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়।
দ্বিতীয় দফা যুক্তিতর্ক শুনানির পর কোনো দিন সাবেক জোট সরকারের মন্ত্রী নিজামীর মামলার রায় ঘোষণা করা হবে, যার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো ১৬টি অভিযোগ রয়েছে।
প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী জামায়াত আমিরের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করে সাংবাদিকদের বলেন, “পঞ্চম অভিযোগে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ দেয়া হয়নি। বাকি সবগুলোই আমরা সম্পূর্ণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ (আসামির অপরাধ) করতে সক্ষম হয়েছি।”
এতে ভিন্নমত জানিয়ে নিজামীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “প্রসিকিউশন এ মামলায় যত সাক্ষী এনেছে, তাদের সবাই অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন।
“১৯৭১ সালে পত্রপত্রিকায় আলবদরের প্রতিষ্ঠাতা যার ছবি ছাপা হয় তিনি মতিউর রহমান নিজামী নন। এসব মিথ্যা সাক্ষীর ভিত্তিতে আনা সব অভিযোগ থেকে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবে বলে আশা করছি।”
নিজামীরটি হবে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার দশম রায়। এর আগের নয়টি মামলায় জামায়াতের জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান আটজন এবং বিএনপির দুই নেতাকে দণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করার পর একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এরপর গত বছর ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মধ্যে একাত্তরের ডিসেম্বরে পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রাম ঘেরাও করে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা ও ৭২টি বাড়িতে আগুন দেয়া, ডেমরা ও বাউশগাড়ী গ্রামে ৪৫০ জনকে গুলি করে হত্যা, সাঁথিয়া উপজেলার করমজা গ্রামে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনাও রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্ম নেয়া নিজামী ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন। জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসাবে একাত্তরে তিনি ছিলেন আলবদর বাহিনীরও প্রধান।
স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছর ২৬ অগাস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন।
আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। বাকি তিনজন হলেন- অ্যাডভোকেট কে এ হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম ও আবদুস সলাম মুকুল।
সাক্ষ্য ও জেরা শেষে গত ৩ থেকে ৬ নভেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রথম দফা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত না হওয়ায় তাদের লিখিত যুক্তিতর্ক জমা দিতে বলে গত ১৩ নভেম্বর নিজামীর মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।
কিন্তু ট্রাইব্যুনাল-১ চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টিএম ফজলে কবীর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেলে এই আদালতের বিচার কার্যক্রমে কার্যত স্থবিরতা তৈরি হয়।
নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম দায়িত্ব নেয়ার পর আসামিপক্ষের আবেদনে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নতুন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের আদেশ দেন।
গত ১৬ মার্চ থেকে নিজামীর মামলায় দ্বিতীয় দফায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। আসামিপক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন শেষে বিচারক মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
দশম রায়
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।
৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়।
ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।
এরপর গত ৯ মে চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উস্কানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গত গত ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।
ষষ্ঠ রায়ে গত ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে।
গত ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।
আর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গত ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।