আফসোস নেই পাভেলের

ক্যামেরায় সেদিন নূর হোসেনের মুখচ্ছবি ধরেননি বলে আফসোস নেই পাভেল রহমানের। নূর হোসেনের কালো পিঠের জমিনে জ্বলজ্বলে সাদায় লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগানটি পরবর্তীতে যেভাবে পুরো জাতিকে আলোড়িত করেছিল তা ভেবে আজো আপ্লুত হন এই আলোকচিত্রী।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2012, 10:58 PM
Updated : 10 Nov 2019, 03:22 PM

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর পল্টন মোড়ে ঝাঁকড়া চুলের নূর হোসেনের খুব কাছ থেকে ছবিটি তুলেছিলেন পাভেল। এর কিছুক্ষণ পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন নূর হোসেন।

পাভেলের তোলা নূর হোসেনের সেই ছবি পরবর্তী দিনগুলোতে সামরিক শাসক এরশাদকে উৎখাতের আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়। দেশে-বিদেশে আলোচিত ওই ছবিটি গণতন্ত্রকামীদের কাছে এখনো প্রাসঙ্গিক।

২৫ বছর আগের সেই দিনের কথা স্মরণ করে অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপি) আলোকচিত্র সাংবাদিক পাভেল রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তখন নিউ নেশন ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসে কাজ করি। সকাল ১০টার দিকে পল্টন মোড়ে ছবি তুলছিলাম। পুলিশ ছিল, লাল পতাকা হাতে আন্দোলনকর্মীদের একটা জমায়েত চলছিল। আর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেইটে কর্মী সমর্থক নিয়ে রাস্তার ওপর ছিলেন খালেদা জিয়া।

“শেখ হাসিনা প্রেসক্লাবের দিক থেকে একটা মিছিল নিয়ে এলেন। একটা জিপে দাঁড়িয়ে নিজেই শ্লোগান দিচ্ছিলেন তিনি। ওই মিছিলের কিছু ছবি তুললাম। পল্টন মোড়, জিপিও হয়ে স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে গোলাপ শাহ মাজারের কাছে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে সেই মিছিল।”

কিন্তু কেন যেন তখন পল্টন মোড় ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি পাভেলের। গোলাপ শাহর মাজারের দিকে যাবেন না- থাকবেন ভাবতে ভাবতেই পাশ দিয়ে এক যুবককে এগিয়ে যেতে দেখতে পান তিনি।

ঝাঁকড়া চুলের খালি গায়ের মানুষটার বুকে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। আর পিঠে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।

“তার মুখটা বিজয়নগরের দিকে। আর আমি জিপিওর দিকে। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল। একুটও দেরি না করে ক্যামেরা হাতে নিলাম। পেছন থেকে দুটো ছবি তুললাম। একটা ছবি দৃঢ়ভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। অন্যটায় হাত উঁচু করে মাথার পিছনে দেওয়া।”

সেদিন সামনে থেকে কেন ছবি তোলেননি? পাভেলের উত্তর- সামনে থেকে তুলতে গেলে অন্য সহকর্মীরাও বুঝে ফেলতো।

“আর সামনে থেকে ছবি না তোলার কারণে পরে কখনো আফসোস হয়নি আমার।”

পাভেল দুটি ছবি তোলার পরপরই পল্টন মোড়ে জমায়েতের মধ্যে মিশে যান নূর হোসেন। লাল পতাকা হাতে জমায়েতটি জিপিও হয়ে স্টেডিয়ামের দিকে এগিয়ে যেতেই গুলি চালায় পুলিশ।

সেদিন সন্ধ্যায় পর পাভেল জানতে পরেন- খালি গায়ের সেই যুবকটিই নূর হোসেন।

“গুলি লাগার পর নূর হোসেনকে তার সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে পুলিশ তাকে কেড়ে নিয়ে ফেলে রাখে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।”

পরদিন নিউ নেশনের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় নূর হোসেনের পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা ছবিটি। সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ল মিছিলে মিটিংয়ে। নূর হোসেনের সেই ছবি পরিণত হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীকে।

“ফটোগ্রাফির ইতিহাসে এই ছবি এখন একটি দৃষ্টান্ত। মুখ ছাড়াও একটা মানুষের ছবি যে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে এটা তার উদাহরণ হয়ে আছে। আমাকেও ফটোগ্রাফার হিসেবে এতো পরিচিতি দিয়েছে ওই ছবিটাই।”

১৯৫৬ সালে রংপুরে জন্মগ্রহণ করা পাভেলের সঙ্গে ক্যামেরার সখ্য কিশোর বয়স থেকেই। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়ানোর পর তার তোলা ছবি প্রথম প্রকাশিত হয় ছাত্র ইউনিয়নের মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’তে। ১৯৭৩ সালে ফটো সাংবাদিকের চাকরি নেন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একতায়।

এরপর কাজ করেছেন কিশোর বাংলা, জনপদ, সংবাদ, নিউ নেশন, বাংলাবাজার ও জনকণ্ঠে। ১৯৮৪ সালে এপিতে যোগ দেয়ার পর এখনো কাজ করছেন এই আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের অনেক ছবি তুলেছেন পাভেল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আলোকচিত্রী হিসেবেও কাজ করেন।

ফটো সাংবাদিক হিসেবে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন পাভেল রহমান।