ফিরে আসা লোড শেডিংয়ে নাজেহাল নগর জীবন

বাচ্চাটা ঘেমে গিয়ে হাঁচি দিতে দিতে ঠাণ্ডা লেগে গেল। এই গরমে বার বার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দেখা গেছে এমন সমস্যা।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2022, 06:30 PM
Updated : 5 July 2022, 06:31 PM

অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে দুই মাসের শিশু ইয়াসির। মা তানজিলা ইসলামের ধারণা, লোড শেডিংয়ের কারণেই তার সন্তান জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে এখন প্রতিদিন ৬-৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরাও ঠাণ্ডা-জ্বরে ভুগছি। আমার শ্বাশুড়ি বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ করে লোড শেডিংয়ে অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে সবার।”

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে জ্বালানি স্বল্পতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি থাকার কথা জানাচ্ছেন সরকারের দায়িত্বশীলরা। ফলে গত কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে বিদ্যুতের লোড শেডিং চলছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, দফায় দফায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার এমন পরিস্থিতি অনেক বছর ধরেই তারা দেখছেন না। আবার ফিরে আসা এই সঙ্কটে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হচ্ছে।

নাখালপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আলতাফ হোসেন জানান, সোমবার রাতে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল।

“বাসায় বয়স্ক মা আছে। বাচ্চারা আছে। ওদের বেশি কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মায়ের ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার। এ পরিস্থিতির সাথে অভ্যস্ত না অনেক বছর। সেজন্য সমস্যা বেশি হচ্ছে। সরকারের কথা শুনে মনে হচ্ছে সমস্যাটা আরও চলবে।”

বাধ্য হয়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে চার্জার ফ্যান কিনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এমনিতেই সবকিছুর দাম বেশি। আবার সামনে ঈদ। এর মধ্যে আরেকটা খরচ করতে হল। কিন্তু এখন তো অত্যধিক গরম চলছে, এছাড়া তো উপায়ও ছিল না।”

এই এলাকার আরেক বাসিন্দা ফারুক আহমেদ জানান, তীব্র গরমে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বেশি ভুগতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, “দিনেও কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে গেছে। গরমটা তো এই সিজনে অসহ্য। বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে রান্না করতেও কষ্ট করতে হচ্ছে।”

উত্তরার দক্ষিণখানের প্রেমবাগান এলাকায় ঘন্টায় ঘন্টায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে জানিয়ে সেখানকার বাসিন্দা তানভীর হোসেন বলেন, “এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে তো এক ঘন্টা থাকে না। একেবারে রুটিন করে যাচ্ছে।

“বাচ্চারা গরমে পড়তে পারছে না। আমার মা হার্টের রোগী, ঘেমে তার ঠাণ্ডা লেগে গেছে। এতদিন তো আইপিএসের প্রয়োজন হয়নি। এখন ভাবছি, আইপিএস ছাড়া চলতে পারব না। আগে তো বাঁচতে হবে।”

সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা ফরিদা ইসলাম জানান, চার ঘণ্টায় তার বাসায় চার বার বিদ্যুৎ চলে গেছে।

এই স্কুল শিক্ষক বলেন, “৩৫-৪০ মিনিট করে বিদ্যুৎ থাকছে না। আমার ফ্রিজের সব খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাছ-মাংসও গলে যাচ্ছে। খুব খারাপ অবস্থা। এমনটা চলতে থাকলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”

মিরপুর ১২ নম্বর ডি ব্লকের আফরোজা ইসলাম জানান, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পানির সঙ্কটও দেখা দিয়েছে।

“সময়মতো পানি পাচ্ছি না। পানি আসছে কম। বিদ্যুৎ না থাকায় মটরে পানি তুলতে পারছি না ঠিকমত। দুই দিন খুব পানির সঙ্কট ছিল। আজকে সেটা কমেছে। ল্যাপটপ-মোবাইল ফোন চার্জেও সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। আর গরমের কষ্ট তো আছেই।”

এই এলাকার একটি বহুতল ভবনের ৮ তলায় ভাড়া থাকেন বেসরকারি চাকরীজীবী তোফাজ্জল হোসেন। বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় জেনারেটর দিয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, “গরম তো আছেই। এর চেয়ে বড় সমস্যা আট তলায় হেঁটে উঠানামা করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর ১০-১৫ মিনিট চালু রাখার পরই বন্ধ করে দিচ্ছে।

“আজকেও কয়েকবার লিফট ছাড়াই ওঠা-নামা করতে হয়েছে। বয়স্ক ও বাচ্চাদের অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

পল্লবীতে বিভিন্ন শ্রেণির বাচ্চাদের বাসায় গিয়ে পড়ান জাহানারা ইসলাম। তিনি বলেন, “আমরা ছোট থাকতে মনে আছে, খুব লোড শেডিং হত। কিন্তু ৭-৮ বছরে লোড শেডিং কী- একবারেই ভুলে গেছিলাম।”

এখন দিনে কয়েকবার করে বিদ্যুৎ না থাকায় খুব সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে এক সময় স্কুলে শিক্ষকতা করা জাহানারা বলেন, “দেখা যাচ্ছে, রাত ১২টার পরে বিদ্যুৎ চলে গেল। গরমে বাচ্চারা অস্থির হয়ে যাচ্ছে।

“বিদ্যুৎ চলে গেলে দুই ঘণ্টার জায়গায় দেখা যাচ্ছে কোনোমতে এক ঘণ্টা পড়ে চলে যাচ্ছে। আর এত গরমে সবারই খুব কষ্ট হচ্ছে।”

বিপাকে ব্যবসায়ীরা

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ফাইল ছবি

ঘন ঘন লোড শেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরাও।

ঢাকার রূপনগরের মোশাররফ কম্পিউটার অ্যান্ড ফটোকপি দোকানের মালিক মোশাররফ হোসেন জানান, তার এলাকায় প্রতিদিন ৭-৮ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

“ধরেন, ফটোকপি বা প্রিন্ট করতে আসল, কারেন্ট না থাকলে আমি কীভাবে সার্ভিস দিব? এতে তো আমাদের লোকসান হচ্ছে। অনেকে আবার কাজ দেয়, করে রাখার জন্য। তাদেরটায় সময়মতো দিতে পারছি না।”

মিরপুর-১২ নম্বরের আধুনিক টেইলার্সের মালিক মো. ইদ্রিস জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকে ৫-৬ বার বিদ্যুৎ গেছে।

“আমাদের কাজগুলো তো মটরের মেশিনে করি। বার বার বিদ্যুৎ চলে গেলে তো কাজেও ব্যাঘাত ঘটে। আমাদের জেনারেটরও নাই। একে তো গরমে টিকতে পারছি না, তার ওপরে কাজও ঠিকমত করা যাচ্ছে না।”

কিউএফসি জেনারেল স্টোরের স্বত্ত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম জানান, লোড শেডিংয়ের কারণে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় বিকাশে গ্রাহকদের সেবা দিতে পারছেন না তিনি।

ফ্রিজে রাখা দোকানের মালামালও নষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “লিকুইড দুধগুলো সকালে দিয়ে গেছে, অথচ এখনও ঠিকমত ঠাণ্ডা হয় নাই। দুধ নষ্টও হয়ে যাচ্ছে। আইসক্রিমও গলে যাচ্ছে। খুব সমস্যার মধ্যে আছি।”

হাসপাতাল চলছে যেভাবে

রাজধানীজুড়ে বিদ্যুৎ নিয়ে ভোগান্তি চললেও দেশের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ আছে। ন্যাশনাল গ্রিডের সাথে আমাদের লাইন থাকায় হাসপাতালে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”

তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে বিদ্যুতের বিকল্প উৎসের ওপর চাপ বাড়াতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এল ইমরান চৌধুরী জানান, জেনারেটর দিয়ে তারা বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাচ্ছেন।

“আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। জেনারেটর দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। তবে তেল খরচটা বেশি হচ্ছে, এই আর কী।”

মিতব্যয়ী হতে হবে: প্রতিমন্ত্রী

জকিগঞ্জে আবিষ্কৃত নতুন গ্যাসক্ষেত্র।

চলমান এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি মঙ্গলবার এক বার্তায় বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে বলেন, “কোভিড-১৯ এর ধাক্কা যখন সবাই কাটিয়ে উঠছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বকেই গভীর এক সঙ্কটে ফেলেছে। এই সঙ্কট শুধু উন্নয়নশীল দেশেই না, অনেক উন্নত দেশেও এর আঁচ লেগেছে। যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি মার্কেট চরম অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য পণ্যের বাজারও বেসামাল। বৈশ্বিক এই সঙ্কট আমাদেরকেও বিপদে ফেলে দিয়েছে।”

সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পথে সরকারের এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে এই পরিস্থিতি ‘ছন্দ পতন’ ঘটাল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এই সময়ে উন্নত বিশ্বকেও ‘রেশনিং’ করতে হচ্ছে জানিয়ে নসরুল বলেন, “আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৬০০-১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। সেখানে আমরা দিতে পারছি মাত্র ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর বেশি গ্যাস আমরা দিতে পারছি না, কারণ আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে কৃষি ও শিল্পখাতকে।”

জ্বালানি পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বাকি বৃহৎ অংশ এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।

“দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করেছে, আমাদের খনিগুলোর রির্জাভ কমে যাওয়ার কারণে। এলএনজি আমদানির জন্য কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় আমরা এলএনজি পাচ্ছি। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি আমদানি করতাম। কোভিড-১৯ এর আগে আমরা এক ইউনিট এলএনজি ৪ ডলারেও আমদানি করেছি, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা ৪১ ডলারও ছাড়িয়ে গেছে।

“এত উচ্চমূল্যে আমদানি করলে আমাদের অর্থনীতির উপর বিশাল চাপ তৈরি হবে। শুধু গ্যাসের দামই না। বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ডিজেল ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলার ছিল সেটা এ বছরের জুনে ১৭১ ডলারে দাঁড়িয়েছে।”

নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান কূপগুলোতে আরও গভীরে খনন করে গ্যাসের অনুসন্ধানের কাজ চলছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এরই মধ্যে আগামী ৩ বছরের একটা আপগ্রেডেশন, ওয়ার্কওভারের স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছি যাতে করে ৪৬টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নতুন করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে।

“এবছরের মধ্যেই পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ভারত থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট আমদানিকৃত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।”

ফলে সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি ‘খুব বেশিদিন থাকবে না’ আশা দেখিয়ে নসরুল বলেন, “আপনাদের নিশ্চয় সবার মনে আছে, ২০০৮ সালের আগে সারাদেশে দিনে ১৬-১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। সেই কঠিন সময়ে আপনারা জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন।

“এই সঙ্কটকালীন সময়েও আপনাদেরকে জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বাস রাখতে বলব। এই সঙ্কট আমরা সবাই মিলেই পার করব। এই পরিস্থিতিতে সবার কাছে একটাই অনুরোধ- আসুন আমরা সবাই গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হই।”