ঈদযাত্রায় মহাসড়কে বাইক বন্ধ: বাইকারদের সন্দেহে বাস মালিকরা

ঈদের আগে ও পরে মহাসড়কে সাতদিন মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন বাইকাররা; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনায় তাদের সন্দেহের তীর বাস মালিকদের দিকে। তবে বাস মালিকরা এতে তাদের সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দিয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2022, 07:16 PM
Updated : 4 July 2022, 04:05 AM

ঈদ যাত্রায় আগামী ৭ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত মহাসড়কে বাইক বন্ধের খবরের লিংক শেয়ার করে সোহানুর রহমান নামে একজন বাইকার ‘বাইক বিডি’ নামে বাইকারদের জনপ্রিয় এক পেইজে লিখেছেন, “অবশেষে ষোল কলা পূর্ণ হল বাস মালিকদের।”

কাজী মঈনুল ইসলাম নামে আরেকজন বাইকার লিখেছেন, “নিউজটা দেখার পর মেজাজ গরম। ৭ জুলাই অফিস শেষ করে (বাইকে) বের হওয়ার প্ল্যান ছিল। এখন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। ৬ জুলাই যাব, তাও বাসে যাব না।”

এর আগে দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু চালুর পরপরই মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বাইকাররা সমালোচনা মুখর হয়েছিল। গত শুক্রবার দুপুরে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেওয়ার দাবি নিয়ে সেতু এলাকায় মানববন্ধনও করেছেন কিছু বাইকার।

তিন দিনের মধ্যে রোববার ঈদযাত্রায় বাইক ব্যবহার করতে না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের আরও ক্ষুব্ধ করেছে।

তাদের ভাষ্য, ঈদের সময় বাসের অনিয়ন্ত্রিত ভাড়া, টিকেট পেতে ঝক্কি, যানজটের দুর্ভোগ এড়াতে গত রোজার ঈদে লাখো মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরেছেন। এবার আগেভাগেই ঈদ যাত্রায় বাইক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত এলে বাস মালিকেদেরই লাভ বেশি।

হঠাৎ করে বন্ধ করে না দিয়ে মহাসড়কে বাইক চলাচলকে ঝুঁকি মনে করা হলে পৃথক লেইন করা কিংবা গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে বলে পরামর্শ বাইকারদের।

রোজার ঈদে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায় মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি। ফাইল ছবি

রোববার ঈদের সময় সাত দিন মহাসড়কে মোটরবাইক চলাচলে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় সরকার। সেই সঙ্গে এক জেলায় নিবন্ধিত মোটরবাইকও অন্য জেলায় চালানো যাবে না বলে নির্দেশনা এসেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রাণালয়ের এক সভা থেকে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে ঈদযাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে এ সভা হয়।

বৈঠক শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “পবিত্র ঈদুল আজহার আগের তিন দিন, ঈদের দিন এবং ঈদের পরের তিন দিন সারাদেশের মহাসড়কে যৌক্তিক কারণ ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যাবে না।”

তবে ‘যৌক্তিক ও অনিবার্য প্রয়োজনে’ পুলিশের অনুমতি নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যাবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

এতে আরও বলা হয়, “অনুমোদিত এলাকার বাইরে মোটরসাইকেল রাইড-শেয়ারিং করা যাবে না পাশাপাশি এক জেলায় রেজিস্ট্রেশন করা মোটরসাইকেল অন্য জেলায় চালানো যাবে না।”

এমন সিদ্ধান্ত আসার পর মোটরবাইক নিয়ে ভারতের দীর্ঘপথে চলাসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করা মোটো ভ্লগার আবু সাঈদের অভিযোগ, “এসবই বাস মালিকদের ফন্দি-ফিকির। গত রোজার ঈদে বহু মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ায় বাসগুলো আশানুরূপ যাত্রী পায়নি। এবারে আগেভাগেই তারা সরকারকে ম্যানেজ করে ফেলেছে।“

ফেইসবুকে সোয়া এক লাখ সদস্যের ‘বাইক বিডি’ পেইজে এ নিয়ে পোস্ট আর মন্তব্যে নিজেদের ক্ষোভ জানাচ্ছেন বাইকাররা।

এ পেইজের এডমিন শুভ্র সেন মনে করেন, মোটরসাইকেল বন্ধ করার আগে মানুষের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্পের ব্যবস্থা করা উচিৎ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, একজন মানুষ কেন মোটরসাইকেলে করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে চাইছেন সেটা ভাবতে হবে। প্রতিবার ঈদের আগে বাসের ভাড়া বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

“পরিবারের দুজন বাড়ি যেতে চাইলে যাতায়াতে শুধু বাসের ভাড়াই লেগে যায় চার থেকে ছয় হাজার টাকা। এরপর অন্যান্য ভাড়াও আছে। সেই বাস কখন আসবে, কখন ছাড়বে সবই বাসওয়ালাদের মর্জি। আছে টিকেট কাটার ঝক্কি।“

রোজার ঈদের ছুটি শেষে ৬ মে মোটরসাইকেলে ঢাকামুখী একটি পরিবার। ছবি:মাহমুদ জামান অভি

তিনি বলেন, সরকার ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা তৈরির পর বাইকের দাম এক ধাক্কায় অনেক কমে গেল। ১০০ বা ১১০ সিসির মোটরসাইকেল কিনতে দেড় লাখের মতো খরচ হচ্ছিল সেগুলোর দাম কমে লাখের নিচে চলে এল। এরপরে নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে আর অনেক মানুষ জীবিকার তাগিদে বাইক চালাতে শুরু করলেন।

তার মতে, এরকম স্বল্প আয়ের মানুষদের অনেকের পক্ষেই যাতায়াতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করা বিলাসিতা। সব কিছু এড়িয়ে নিজের মত করে বাড়ি যেতে মানুষ তাই বাইক বেছে নিয়েছেন।

হঠাৎ বাইক বন্ধের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “হাজার টাকার তেল হলেই দুজন অনায়াসে ঈদযাত্রাটা সেরে ফেলতে পারেন। মানুষের সমস্যা সমাধান না করে এভাবে হুট করে মহাসড়কে বাইক বন্ধের সিদ্ধান্ত খুবই হতাশাজনক। দু-একজন বেপরোয়া বাইকারের জন্য সব ব্যবহারকারীকে এভাবে বিপদে ফেলার কোনো মানে হয় না।“

দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ঘোষণা আসার পর বাইকারদের অনেকে ঈদে সেতু হয়ে বাড়ি যাবেন বলে পরিকল্পনা করছিলেন। স্বপ্নের সেতুতে উঠতে পারছেন না, ঈদে বাইকে যেতে পারবেন না এমন সিদ্ধান্ত তাদের মর্মাহত করেছে জানিয়ে শুভ্র সেন বলেন, “বাইক বিডি পেইজের সদস্যরা সরকারের এসব সিদ্ধান্তের পেছনে বাস মালিক সিন্ডিকেটকে সন্দেহ করছেন। এই নিয়ে গ্রুপে প্রচুর পোস্ট আসছে। বাইকারদের অসংখ্য ফোন ও এসএমএম আসছে।“

গত রোজার ঈদে বাড়ি যেতে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে বাইক চালকদের ছিল এমন ভিড়। ফাইল ছবি

 

অনেকে এ নিয়ে কর্মসূচি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাস মালিক-শ্রমিকদের মত বাইকারদের তো কোনও সংগঠন নেই, ইউনিয়ন নেই। আমরা নিজ নিজ প্রয়োজনের তাগিদে বাইক চালাই। আমাদের রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করার মত পরিস্থিতি নেই- এ কথা তরুণ বাইকারদের কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না।”

তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের বিষয়ে বাস মালিকদের কোনও অবস্থান নেই জানিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহনের কর্ণধার খন্দকার এনায়েত উল্যাহ রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রণালয়ে যে মিটিং হয়েছে সেখানে আমরা (মালিক সমিতির প্রতিনিধি) ছিলাম না। সেখানে আমাদের কোনও পার্টিসিপেশন নেই। সরকার মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দিলে এখানে মালিক সমিতির কী করার আছে।

“আমরা তো কাউকে বলি নাই যে মোটরসাইকেল বন্ধ করে দিক। আর মালিক সমিতির কথায় তো সরকার কাজ করে না। আমি এসব জানতামও না। কিছুক্ষণ আগে টেলিভিশন এ খবর দেখছি।”

আরও পড়ুন