অশীতিপর বৃদ্ধের বয়ান: ‘ই রখম বইন্যা হায়াতে দেখছি না’

১৯৭০ সালের সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার ক্ষত এখনও অশীতিপর আবুল খায়েরের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে; এর ঠিক ১৮ বছর পর ১৯৮৮ সালে আরেকটি বড় বন্যার সময় তো তিনি বয়সে বেশ পরিণতই ছিলেন।

মাসুম বিল্লাহ সুনামগঞ্জ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2022, 04:04 AM
Updated : 2 July 2022, 08:14 AM

কিন্তু তার জীবদ্দশায় যত বন্যা গেছে, এবারকার বান ভয়াবহতার মাত্রায় আগের সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের এই বাসিন্দা।

সিলেট অঞ্চলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি স্পষ্ট হওয়ার মধ্যে আবুল খায়ের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “ই রখম বইন্যা আমার হায়াতে দেখছি না।”

জন্ম থেকে সুনামগঞ্জের দেখার হাওরের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে পানির সঙ্গেই যেন তার মিতালী। ওই হাওরের মধ্যবর্তী দক্ষিণ বড়বন এলাকায় ৫০ বছর ধরে বাস করছেন আবুল খায়ের। তার যৌবনও কেটেছে এই হাওরেরই আরেক অংশে।

গত ১৭ জুন থেকে তার ঘরে যখন বানের পানি উঠতে থাকে, তখনও নিজের ঘরেই ছিলেন তিনি। ক্রমান্বয়ে পানি উঠে যায় প্রায় কোমর-অবধি।

উঁচু স্থানে যাওয়ার জন্য পরিবারের সাথে ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চড়তে গিয়েও শেষমেশ ফিরে আসেন আবুল খায়ের। ভয়, আতঙ্ক আর জীবনবাজি রেখে আপন নিবাসেই তারা থেকে যান।

পাশাপাশি দুই ঘরে খাটের উপর রাখা আরেক খাটে তিন দিন পার করতে হয় ওই পরিবারের ৮ সদস্যের। রান্নাবান্নাও হয় খাটের উপর, টিনের চুলায়।

বাসের আলোয় এভাবেই হঠাৎ আলোকিত হয়ে ওঠে সুনামগঞ্জ শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরের জানিগাঁও এলাকায় মহাসড়কে বানভাসিদের আশ্রয়স্থল। সেখানে বাঁশ-প্লাস্টিকের তৈরি তাবুর মত ৩০টি অস্থায়ী নিবাসে দিবারাত্রি পার করছে প্রায় ৪০টি পরিবার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি।

জীবনবাজি রাখার সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে আবুল খায়ের বলেন, “এমন আফাল (স্রোত) আছিল যে, নৌকাত টিকতে পারমু কি-না, ওউ চিন্তাত আছলাম। বাদে চিন্তা করলাম, মরলে নিজের ঘরেই মরমু।”

বন্যায় আবুল খায়েরদের একটি মাটির লেপ দেওয়া ঘরের কিছু অংশ ভেঙে গেছে; নষ্ট হয়েছে কয়েক মণ ধান। তবে, এই পাল্লায় রক্ষা পেয়ে বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে উঠছে ভাটির দেশের এই বৃদ্ধ।

অশীতিপর খায়েরের কথার প্রতিফলিত হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায়ও; এবারকার সিলেট অঞ্চলের স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হিসাবে চিহ্নিত করছেন তারা।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, জীবদ্দশায় অন্তত সাতটি বড় বন্যা দেখেছেন আবুল খায়ের। ১৯৭০ ও ১৯৮৮ সাল ছাড়াও ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৯৮, ২০০০ ও ২০০৪ সালে বন্যার ভয়াবহতা তিনি দেখেছেন।

অতীতের তথ্যের শরণ নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে এবারের বন্যা ১২২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট-সুনামগঞ্জ এলাকায় পানির উচ্চতা ১৯৮৮, ১৯৯৮ কিংবা ২০০৪ সালের চেয়ে বন্যার পানির উচ্চতায় নতুন রেকর্ড করেছে।

উজানের ঢল, নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে পানি প্রবাহিত হতে না পারা এবং অপরিকল্পিত অবকাঠামোকে বন্যা বেশি ভয়াবহ হওয়ার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তারা।

সিলেটের খুব কাছের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে আর ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়ও এবার কয়েক বছরের মধ্যে বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে।

ছবি: কামাল হোসেন তালুকদার

‘মানুষ বুঝতে পারেনি এত পানি উঠবে’

অতীতের অভিজ্ঞতা মাথায় রাখার কারণে এবারের বন্যাকেও স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল বন্যাপীড়িত অঞ্চলের মানুষ। ফলে ক্ষতির পরিমাণ অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা বলছেন ভুক্তভোগীরাই।

দেখার হাওরের বড় বন এলাকার দোকানি কবিরুল ইসলাম বলেন, “আমরা কেউ ভাবি নাই এত পানি উঠবে। কিন্তু হঠাৎ করে পানি, পানি আর পানি। ক্ষতি সে কারণে বেশি হয়েছে।”

বানের পানির স্রোতের মধ্যে নৌকায় করে দোকানের কিছু মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার কথা জানান তিনি। মালামাল পানিতে বিসর্জন দিয়ে নিজের জীবন বাঁচানোর কথা উল্লেখ করেন কবিরুল।

সুনামগঞ্জের সত্তরোর্ধ্ব আলী আমজাদও বললেন, এবারের বন্যার ভয়াবহতা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি হলেও মানুষ সেভাবে ভাবেনি।

”পাহাড়ি এলাকা। একদিন পানি আইলে পরেরদিন চলে যায়। আমরা কোনোদিনও ভাবি নাই এমন হতে পারে।”

সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অগুনিত মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় সড়কে। দোয়ারাবাজারের মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আমবাড়ি এলাকার তৈরি অস্থায়ী নিবাসে তার প্রহর গুনছে নিজের বাড়িতে ফেরার। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

পানি বাড়তে থাকলে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের টেকনিক্যাল কলেজে পরিবারসহ আশ্রয় নেন আলী আমজাদ। এরপর ফিরে এসে উঠেছেন দক্ষিণ বড়বন গ্রামে সম্বন্ধির বাড়িতে।

ঘর কিছুটা অংশ ভেঙে যাওয়ায় এবং ভিটে কর্দমাক্ত হওয়ায় ১৫ দিনেও সেখানে ফিরতে না পারার কথা জানান তিনি।

নিজেদের নৌকা নাই দোয়ারাবাজারের দক্ষিণ বড়বন এলাকার কামরুন নেছার পরিবারের। বন্যার যখন ধেয়ে আসছিল, অগত্যা ছেলেকে নিয়ে প্রতিবেশীর নৌকায় চড়ে উঁচু জায়গার উদ্দেশে রওয়ানা করেছিলেন অশীতিপর এই নারী।

কিন্তু ঢেউয়ের তোড়ে ছোটো নৌকার ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পেরে তারা আবার ঘরেই ফিরে আসেন। ঘরে হাঁটুজল নিয়ে তিন দিন পার করেন তারা।

খাটের উপর আরেকটি খাট তুলে ওই সময়ে থাকেন তারা। শুকনো খাবার আর টিনের চুলার রান্না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয় তাদের।

সেদিনের নৌকায় চড়ার কথা স্মরণ করে তিনি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরার নৌকা নাই। নৌকায় যখন উঠছি, তখন মেঘ, তুফান, জলি…ঠাস করি ঘুরাইলাই, ঠাস করি ঘুরাইলাই। পরে লামি আইছি।”

এখনও ঘর ঠিক করতে পারেননি কামরুন নেছারা। বন্যায় ভেসে যাওয়া চুলায়ও রান্নার ফুরসৎ নাই। সরকারের ত্রাণের আশায় থাকার কথা জানান ৮০ বছরোর্ধ্ব কামরুন নেছা।