এমন দুর্যোগের দিনে এসব দেখতে দেখতেই বন্যার স্রোতের মধ্যে দুই শিশুকে দুই কাঁধে নিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটেছেন শাহিদা বেগম; তার গন্তব্য প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের একটি উঁচু ভবন।
তিনদিন পর বানের জল নেমে যাওয়ায় নিজেদের ঘরে ফিরতে চাইলেন শাহিদারা; কিন্তু ঘরে পানি না থাকলেও পুরো ভিটে যেন হয়ে ছিল কাদামাটির ঢিবি।
পরিবারের মোট ১০ জন সদস্য নিয়ে তারা সেখানে থাকছেন; পাশের আরেকটি পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে টিনের চুলোয় রান্নাবান্না চলছে।
ঘরে চাল আর হাঁস-মুরগী যা ছিল, তা ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। দুয়েকবার ত্রাণ পেলেও অধিকাংশ সময়ে শাহিদার বড় ভাই কাইয়ুম কষ্টেশিষ্টে পরিবারের আহার জুটাচ্ছেন।
বানের তোড়ের মধ্যে পড়িমড়ি করে নিরাপদ আশ্রয়ের পথে ছুটে যাওয়ার বর্ণনা যেমন দিচ্ছিলেন, তেমনি খেয়ে না খেয়ে সড়কের মধ্যেই পানি কবে কমবে সেই প্রহর গোনার কথা বলছিলেন শাহিদা।
”কিন্তু ঘরের মধ্যে যে প্যাক, বেড়া ভাইংগা গেছে-এ কারণে বাধ্য হয়ে রাস্তার উপরে আছি আমরা। উপায় তো নাই।”
দোয়ারাবাজারের মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আমবাড়ি এলাকায় অস্থায়ী নিবাসের ঠিক পাশেই শাহিদাদের মাটি, বেড়া আর টিনের বেড়ার ঘর।
সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় শাহিদাদের মত বহু মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়ে সড়কে। ঘরে ফেরার প্রহর গুণলেও কখন ফেরা হবে, তা অজানা তাদের কাছে।
শুধু ভেতরের বড় সড়কে নয়, সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জায়গায় জায়গায় অস্থায়ী আবাস গড়েছেন বানভাসী মানুষ।
আগের দু’দফা বন্যার পর তৃতীয় দফায় আর রেহাই পাননি তারা। মানুষের পাশাপাশি অনেকের গবাদিপশুর অস্থায়ী আবাসও হয়েছে সড়ক-মহাসড়ক। সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাও করতে হচ্ছে সেখানকার মানুষদের।
শুক্রবার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, এ জেলায় বন্যায় এবার ৪৫ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে।
তাছাড়া এখনও ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক ঘরবাড়ি পরিসংখ্যানের বাইরে রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে আরও এক মাস সময় লাগবে বলে প্রশাসনের ভাষ্য।
শাহিদাদের ঠিক পাশেই বাঁশ-প্লাস্টিকের অস্থায়ী ঘরে আবাস নিয়েছেন আয়েশা বেগমের পরিবার। টিনের চুলায় একজনের রান্না যখন শেষ হয়, তখনই শুরু হয় অন্যদের খাওয়ার আয়োজন।
অস্থায়ী ঘর থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে আয়েশাদের ভিটেমাটি। বানের তোড়ে ঘর ভেঙেছে, পানি নেমে যাওয়ার ১১-১২ দিন পার হলেও ঘর এখনও কাদামাটিতে ভরা।
শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে যখন তার সঙ্গে কথা হয় নাতিকে কোলে নিয়ে আনমনে তাকিয়েছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী। কোলে ছিল তিন বছরের নাতনী আর কপালে চিন্তার ভাঁজ-কখন ফিরবেন আপন ঘরে?
দুয়েক সময় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে ত্রাণ পেলেও সব কিছু হারিয়ে খাবারের বন্দোবস্ত করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরের জানিগাঁও এলাকার মহাসড়কের উপর তাবুর আকারে তৈরি করা হয়েছে বাঁশ-প্লাস্টিকের ৩০টির মতো অস্থায়ী নিবাস। ওই এলাকায় সার বেঁধে দিবারাত্রি পার করছে প্রায় ৪০টি পরিবার।
শুক্রবার সন্ধ্যার পর সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ক্ষণে ক্ষণে বিকট হর্ন বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে বড় বড় বাস। তার পাশেই শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে সময় পার করছেন বানভাসি মানুষেরা।
ওই সময়ে দুয়েকটি ত্রাণ বিতরণের গাড়িও ঘুরে যেতে দেখা গেছে সেখানে। ওইসব গাড়ি দেখে ব্যস্ত ওই মহাসড়কে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন বিভিন্ন বয়সি মানুষ।
বন্যার প্রথম কয়েকদিন বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে স্থানীয় একজনের পাকাবাড়িতে উঠেছিলেন তারা। এরপর অস্থায়ী নিবাস গেড়ে জানিগাঁও এলাকায় অবস্থান নিয়েছে দিলবী বেগমের পরিবার।
দিলবী বেগম বলেন, মহাসড়কের উপরে থাকায় ত্রাণ ’ভালো’ পেলেও ঘরবাড়ি এখনও বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেনি। কারণ ঘর ভেঙেছে আর ভিটে কাদায় ভরপুর।
সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়কের জালালপুর এলাকায় বাঁশ-প্লাস্টিকের অস্থায়ী ঘরে একপাশে থাকছে মুনফর আলীর পরিবার আর আরেক পাশে রাখা হয়েছে তাদের গবাদিপশু।
মুনফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘরে ফেরার জো নাই। গরুর পাশেই থাকি আমরা। বৃষ্টি-বাদল হলে বেশ অসুবিধা হচ্ছে এখানে।