মৃত্যুর পর ৫-৬ মাস খলিলের লাশ খুঁজে বেড়িয়েছেন ইউনুসরা। বেওয়ারিশ লাশ পাওয়ার খবরে কখনও ছুটে গেছেন ভোলায়, কখনো চাঁদপুর কিংবা শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায়।
ভাইয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে সে সময় পত্রিকায় ছবিসহ বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন তারা। একবার খবর পেলেন, বরিশাল কারাগারে এক কয়েদি দেখতে খলিলের মত।
অনেক চেষ্টা তদবির করে ইউনুস সেখানে গিয়ে দেখলেন, তার ভাইয়ের সাথে ওই কয়েদির চেহারায় মিল আছে ঠিক; কিন্তু তিনি খলিল নন।
এরকম বহুবার ভাইয়ের খোঁজ মেলার আশা নিয়ে ছুটেছেন ইউনুসরা; কিন্তু গত ১৮ বছরে ভাইয়ের লাশটিও তারা আর পাননি।
বছর বছর এরকম অসংখ্য নৌযান দুর্ঘটনায় প্রমত্তা পদ্মায় হারিয়ে গেছে বহু প্রাণ। স্বজন হারানোর সেই বেদনায় নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দাদেরই পুড়তে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তাদের কাছে শনিবার উদ্বোধন হতে যাওয়া পদ্মা সেতু যেন ডুবে না মরার নিশ্চয়তা।
ইউনুস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যে কোনা নৌযানে পদ্মা পাড়ি দিতে গেলেই তার মনে ভয় ধরে, ভাইয়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে।
“ওই ঘটনার পর থেকে সবসময় একটা আতঙ্ক কাজ করে। গত কয়েক মাস আগে জরুরি প্রয়োজনে স্পিডবোটে পদ্মা পার হতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ডুবে যাব। একবার ফেরি পারাপারে সময় আমার ছেলেও স্মরণ করছিল, এখানে তার চাচা হারিয়ে গেছে।”
পদ্মা সেতু চালু হলে সেই ভয় আর আতঙ্ক জাগানিয়া সময় অতীত হয়ে যাবে বলে মনে করেন মাদ্রাসা শিক্ষক ইউনুস। তিনি বলেন, “আমাদের জন্য যাতায়াতটা সহজ হয়ে যাবে। আতঙ্ক যেটা ছিল এতদিন, সেটা আর থাকবে না।”
গত বছর ৩ মে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাট সংলগ্ন কাঁঠালবাড়ি ঘাট এলাকায় পদ্মায় নোঙর করা জাহাজের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষে ২৬ জনের সলিল সমাধি হয়েছিল।
২০১৪ সালের ৪ অগাস্ট পদ্মায় পিনাক-৬ লঞ্চডুবির পর মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জের ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। আরও ৫০ জন যাত্রীর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পিনাক-৬ লঞ্চডুবিতে নিজের ভাই, ভাবি ও দুই ভাতিজা-ভাতিজিকে হারিয়েছিলেন মাদারীপুরের শিবচরের কোহিনূর রহমান।
ঢাকার মিরপুরে একটি গার্মেন্টস ছিল তার ভাই মিজানুর রহমানের। ঈদের ছুটি কাটিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে রাজধানীতের ফিরছিলেন তিনি।
পদ্মা সেতু হয়ে গেলে কষ্ট লাঘবের আশা করছেন কোহিনূর। কিন্তু তার কেবলই মনে পড়ছে ভাই আর তার স্ত্রী-সন্তানদের কথা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কোহিনূর বলেন, “আমরা পদ্মার এপারের মানুষ জানি, কতটা কষ্ট আর ঝামেলা মোকাবেলা করে আমাদের যাতায়াত করতে হত। সেতুটা যদি তখন থাকত, আমাদেরকে এমন বেদনা বয়ে বেড়াতে হত না।
“সেতুটা উদ্বোধন হোক, আমাদের সেই কষ্ট আর থাকবে না। আমাদের বেদনাও হয়ত কিছুটা কমবে। যাতায়াত খুব সহজ হয়ে যাবে।”
বলা হচ্ছে, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে। তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে গোটা দেশের অর্থনীতিতে।
এতদিন ফেরিতে পদ্মা পার হতে কম করেও দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যেত। আর বৃষ্টি-কুয়াশা, স্রোত-বাতাসের মত প্রাকৃতিক কারণ, কিংবা ঈদযাত্রার ভিড়ের মধ্যে সেটা কতক্ষণে গড়াত, তার কোনো ইয়াত্তা নেই।
এরকম পরিস্থিতিতে ফেরির জন্য অপেক্ষায় থাকা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর রোগীর মৃত্যুর খবরও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত নড়াইলের কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন স্বজনরা।
কিন্তু সরকারের এটুআই প্রকল্পে দায়িত্বরত যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর রাত ১১টার দিকে ফেরিটি মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের উদ্দেশে রওনা করে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ফেরিতেই মারা যায় তিতাস।
হাই কোর্টের নির্দেশে তদন্ত করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি পরে বলেছিল, পরোক্ষভাবে হলেও যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল দায় এড়াতে পারেন না।
রোগী নিয়ে ফেরি পার হতে স্বজনদের কতটা কষ্ট আর ঝক্কি পোহাতে হত, তার সাক্ষী পদ্মা পাড়ের বিভিন্ন জেলার অ্যাম্বুলেন্স চালকরাও।
পঞ্চাশোর্ধ্ব মোশারফ শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "গাড়ি চালানো অবস্থায় কত রোগীরে মরতে দেখছি, তার কোনো হিসাব নাই। ঢাকায় পৌঁছায়া বাবুবাজার ব্রিজের কাছে নিতে নিতে কত মানুষরে আল্লায় নিয়া গেছে, মাঝিরঘাট যাওয়ার পরেই আল্লায় নিয়া গেছে।“
এমন অগুনতি অভিজ্ঞতার একটি শুনিয়ে তিনি বলেন, “বছর ৫-৬ আগের কথা। ঘড়িসার থেইক্কা স্ট্রোক করা এক রোগী নিয়া যাইতাছিলাম। বয়স ষাইট পয়ষট্টি। সাথে তার বড় ছেলেও ছিল। মাঝিরঘাট গিয়া দেখি ফেরি নাই৷
“একটা ফেরি আইলে কোনোরকমে ঠেইল্লা অনেক কাহিনী কইরা উঠছি। ওইদিকে রোগীর অবস্থা খারাপ। ওপারে ঘাটে নাইম্মা বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত গেছি৷ ওইখানেই তার দম গেছে।"
তবে এম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে সেতুর টোল কিছুটা কমিয়ে আনার আবেদন জানিয়ে মোশারফ বলেন, “আমার গাড়িতে গ্রাম থেকে অনেক গরীব মানুষও রোগী নিয়া ঢাকার দিকে যায়৷ তাগো কাছে আমি সবসময় ভাড়া কম রাখি। সেতুর টোল ১৩ শ টাকা হইলে আমাগো লাইগা একটু কষ্টের হইয়া যায়।”
পদ্মা সেতু হয়ে গেলে রোগী ও তাদের স্বজনরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বলে মনে করছেন ঘড়িসার আধুনিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজার আহমেদ অপু।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে প্রতি মাসে, ক্ষেত্রবিশেষে সপ্তাহে একবার করে ঢাকা থেকে ডাক্তার আসত। ডাক্তারের সংকট ছিল অনেক। ফেরি কিংবা লঞ্চে পদ্মাপাড়ি দিয়ে ডাক্তাররা খুব একটা আসতে চাইতেন না।
“যেহেতু এখন পদ্মাসেতু হয়েছে, ঢাকার সাথে এই এলাকার দূরত্বও অনেকটা কমেছে। আশা করছি, এখন বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলোতে ডাক্তারের সংকট থাকবে না।"