সন্তানদের জিম্মা: জাপানি নাকানোর অপেক্ষা বাড়ল ৩ সপ্তাহ

আইনজীবীদের মধ্যস্ততায়ও দুই শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব ও জিম্মার বিষয়ে সমঝোতায় আসতে পারেনি তাদের মা জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো ও বাবা বাংলাদেশি ইমরান শরীফ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2021, 02:23 PM
Updated : 30 Sept 2021, 02:23 PM

এমন পরিস্থিতিতে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি ফের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত মুলতবি রেখেছে।

ততদিন নাকানো শিশুদের সঙ্গে থাকতে পারবেন সারক্ষণ। তবে তাদের বাবা কেবল দিনের বেলা তাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন।

১৬ সেপ্টেম্বর দুই শিশুর অভিভাবকত্ব চেয়ে নাকানো এরিকোর রিট আবেদনটির শুনানি মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি রেখে সমঝোতার জন্য সময় দেওয়া ছিল।

এর মধ্যে শিশুদের নিয়ে মা-বাবাকে পলা করে থাকতে বলেছিল আদালত। অর্থাৎ শিশুদের সাথে যেদিন মা থাকবেন, সেদিন বাবা থাকতে পারবেন না। আবার বাবা যেদিন থাকবেন, সেদিন মা থাকতে পারবে না।

এই প্রক্রিয়ায় মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকার পর ইমরানের আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ সমঝোতা বা সমাধানের জন্য আরও সময় চান। তা নিয়ে আপত্তি তোলেন নাকানোর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

পরে আদলত দুই দিনের সময় দিয়ে বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য রাখে। কিন্তু  রোকনউদ্দিন মাহমুদ বুধবার এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।

বৃহস্পতিবার শুনানিতে সে প্রসঙ্গ তুলে নাকানো এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর (রোকনউদ্দিন মাহমুদ) মাধ্যমে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

“এখন এ পরিস্থিতিতে বিষয়টির সৌহার্দপূর্ণ সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। তাই এ বিষয়ে আদালতের আদেশ প্রার্থনা করছি।”

এসময় ইমরান শরীফের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল, ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।

আইনজীবী ফিদা এম কামাল শুনানিতে বলেন, “ইমরান শরীফ বেআইনি বা অবৈধভাবে জাপান থেকে শিশুদের বাংলাদেশে নিয়ে অসেনি। বৈধ পন্থাতেই তিনি বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন। আর শিশুরাও বাবার সাথে থাকতে চেয়েছে বলেই নিয়ে আসা হয়েছে।

“এখন যদি নাকানো এরিকোর জিম্মায় শিশুদের দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সে শিশুদের জাপানে নিয়ে যাবে। বাবা আর বাচ্চাদের ফিরে পাবে না। এ বিষয়ে আদেশ দিতে চেইলে আদালত যেন বাচ্চাদের কথা শুনে অদেশ দেয়।”

পরে আদালত ২১ অক্টোর পর্যন্ত বিষয়টি মুলতবি করে।    

দুই শিশুর অভিভাবকত্ব চেয়ে মা নাকানো এরিকো রিট আবেদন করলে গত ১৮ অগাস্ট এক আদেশে হাই কোর্ট দুই শিশুকে হাজির করতে বলে।

শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ ও তার বোন আমিনা জেবিনকে (শিশুদের ফুপু) ওই নির্দেশ দেওয়া হয়। ইমরান শরীফ যাতে দুই মেয়েকে নিয়ে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য তাদের দেশত্যগে নিষেধাজ্ঞাও দেয় আদালত।

এর মধ্যে গত ২২ অগাস্ট দুই শিশুকে ইমরান শরীফের বারিধারার বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারপর থেকে তারা মহানগর পুলিশের সাপোর্ট সেন্টারে ছিল।

সেখান থেকেই গত ৩১ অগাস্ট দুই শিশুকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ।

উন্নত পারিবারিক পরিবেশে শিশুদের রাখতে তাদের মা এরিকো ও বাবা ইমরানের আবেদনের পর সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে ওইদিন আদেশ দেয় আদালত।

সে আদেশে ইমরান শরীফের ঠিক করা গুলশানের একটি ফ্ল্যটে দুই শিশুকে নিয়ে আপাতত ১৫ দিন একসাথে থাকতে বলা হয় তাদের।

ঢাকা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালককে বলা হয়েছিল, বিষয়টি দেখভাল করতে। আর ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বলা হয়েছিল, শিশু ও মা-বাবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

কিন্তু সাত দিনের মাথায় গত ৩০ আগস্ট সে অদেশ পরিমার্জন (মোডিফিকেশন) চেয়ে আদালতে আবেদন করে নাকানো এরিকোর আইনজীবী।

৩১ আগস্ট সে আবেদনের শুনানির পর হাই কোর্ট সন্তানদের সথে মা-বাবার থাকা এবং তাদের সময় কাটানোর বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে দেয়।

আদালত বলে দেয়, ৯, ১১, ১৩ ও ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে ওই বাসায় মেয়েদের সাথে মা থাকবেন, বাবা থাকবেন না। বাকি সময়টা বাবা-মা দুজনেই শিশুদের সাথে থাকতে পারবেন।

তাছাড়া মা-বাবা চাইলে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যেতে পরবেন। কেনাকাটা করতে পারবেন, বাইরে খেতে পারবেন।

পরদিন অর্থাৎ ১ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের এ আদেশ স্থগিত চেয়ে ইমরান শরীফ আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করলেও চেম্বার বিচারপতি সেদিন হাই কোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপ করেননি।

তারই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার মামলাটি আদালতে উঠলে দুই পক্ষই সম্পূরক আবেদন নিয়ে দাখিল করে।

মা নাকানো এরিকোর আবেদনে একটি আরজি ছিল শিশুদের সাথে মা-বাবার থাকা বা সময় কাটানোর সময়, দিনক্ষণ আলাদা করে দেওয়া। যদিও এতে আপত্তি তুলেছিলেন শিশুদের বাবা ইমরান শরীফের আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ।

কিন্তু আদালত সে আপত্তিতে কর্ণপাত না করে অদেশ দেয়।

এ বিসয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আমরা তো চেয়েছিলাম একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া হোক। তারপরেও যেহেতু হচ্ছে না তাই আমরা পর‌্যায়ক্রমে থাকার আদেশ দিলাম।”

আদালতের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই নাকানো এরিকো (৪৬) ও ইমরান শরীফ (৫৮) বিয়ে করেন। দুজনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। দুজনের কেউই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি।

এর মধ্যে দাম্পত্য কলহ-বিবাদের জেরে গত ১৮ জানুয়ারি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো।

টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন। তাদের বয়স যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ বছর। তিন মেয়ে টোকিওর একটি স্কুলে পড়ে।

গত ২১ জানুয়ারি ইমরান টোকিওর ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার এক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন নাকচ করে।

পরে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে এরিকোর ভাষ্য।

২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করলে এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন।

এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মায় চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন এরিকো।

টোকিওর আদালত গত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেয়। তবে ওই আদেশ না মেনে ইমরান শরীফ শুধু একবার মায়ের সঙ্গে বড় দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন বলে এরিকো হাই কোর্টে করা আবেদনে বলেছেন।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।

এদিকে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে বড় দুই মেয়ের জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেয়।

বাংলাদেশের হাই কোর্টে করা রিট আবেদনে এরিকো বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এতদিন বাংলাদেশে আসতে পারেননি তিনি। গত ১৮ জুলাই শ্রীলঙ্কা হয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন।

এরিকো জানান, ইমরান মেয়েদের সঙ্গে দেখা করাতে গত ২৭ জুলাই তাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতে তার মনে আশঙ্কা হয়, ইমরান মেয়েদের আর কখনও তার সঙ্গে ‘দেখা করতে দেবেন না’। এ কারনেই তিনি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।