২৯ বছর পর মোবাইল নম্বরই ধরিয়ে দিল আজাদকে

রংপুরের মিঠাপুকুরে একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডের আসামি আবুল কালাম আজাদ ২৯ বছর পালিয়ে ছিলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকায় বসবাস করছেন ২০ বছর ধরে। তবুও শেষটা ‘সুবিধার’ হল না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2021, 03:36 PM
Updated : 6 Sept 2021, 04:18 PM

অনেকটা ভুলে যাওয়া এই মামলার আসামী আজাদ ফোন নম্বরের সূত্র ধরে অবশেষে ধরা পড়েছেন র‌্যাবের হাতে।

যুবক বয়স থেকে পালিয়ে থাকার দিনগুলোতে মাঝে বিয়েও করেছেন পরিচয় গোপন করে; যদিও সংসার বেশিদিন টিকেনি।

পরিচিতজনদের থেকে আড়ালে থাকতে ঢাকায় পার করেছেন দুই দশক। মাদ্রাসার ডিগ্রি থাকলেও আত্মগোপনের সুবিধায় জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ।

৫৩ বছর বয়সী এই ব্যক্তি পুলিশ ও পরিচিতদের এড়িয়ে মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে দেখাও করতে যেতেন। সব কিছু এতদিন ভালোই চলছিল।

তবে একটি সূত্র থেকে খবর পেয়ে পুলিশ তার ফোন নম্বর জোগাড় করলে আর শেষ রক্ষা হল না।

রোববার রাতে রাজধানীর মিরপুর পাইকপাড়া থেকে ১৯৯২ সালে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে খুনের ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আজাদকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

এতদিন কেন ধরা পড়েননি জানতে চাইলে মিঠাপুকুর থানার ওসি মো. জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি ছিল না। চেষ্টায় ছিলাম কিন্তু কোনো তথ্য পাচ্ছিলাম না।

“সম্প্রতি একটি সূত্র থেকে জানতে পারি আজাদ ঢাকায় থাকে এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন।“

হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “আর যাবে কোথায়? অনেক চেষ্টা করে একজন সোর্সকে দিয়ে আজাদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করি গত ২৬ অগাস্ট।

“পরে ট্র্যাক করে জানতে পারি ঢাকার মিরপুর এলাকায় বসবাস করছে আজাদ।“

ওসি জানান, এরপর র‌্যাবকে তথ্য দিলে র‌্যাব-৪ যাচাই-বাছাই করে পাইকপাড়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করলে ১১ বছর আগেই তার সাজার মেয়াদ শেষ হত।

তার সঙ্গে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামিরা এখন মুক্ত। আর আজাদের সাজার দিনক্ষণ গণনা শুরু হল ২৯ বছর পর থেকে।

তাকে গ্রেপ্তারের পর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক জানান, রংপুরের মিঠাপুকুরে মো. ইব্রাহিম ওরফে ইব্রা হত্যা মামলায় আজাদের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করেছিল আদালত।

তিনি বলেন, “ওই মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে ২০০১ সাল পর্যন্ত রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে থাকেন তিনি। এরপর পরিচিতি লোকজনের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে ২০০১ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন।

“মাদ্রাসায় ফাজিল পাশ আজাদ চাকরি না করে নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করে আসছিলেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে তিনি নাম দিয়েছেন আজাদ মিয়া। তবে বাবার নাম ও অন্য পরিচয় ঠিক ছিল।”

১৯৯২ সালের ২৪ জুন মিঠাপুকুর থানার গুটিবাড়ী সরকারপাড়া এলাকায় জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হামলার শিকার হয়ে মারা যান ইব্রাহিম।

বাজার থেকে ফেরার পথে প্রতিপক্ষের কয়েকজন মিলে ধারলো দেশি অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে গুরুতর জখম করে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

ওই ঘটনায় মিঠাপুকুর থানায় আজাদসহ ৬ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন ইব্রাহিমের ভাই মো. মফিজ উদ্দিন।

সে বছর ডিসেম্বরেই আজাদসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এজাহারে নাম থাকা বাকি ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পরে আসামি আজাদ, ফারাজ উদ্দিন ও আবু ওরফে আবু ডাকাতকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারক।

আদালতে সাজা ঘোষণার সময় ফারাজ আটক ছিলেন। পরে পুলিশ আবু ডাকাতকে গ্রেপ্তার করলেও আজাদ পলাতকই থেকে যান।

ওসি জাকির হোসেন বলেন, ফারাজ উদ্দিন ১৮ বছর সাজা ভোগ করে এলাকায় কৃষি কাজ করে জীবনযাপন করছেন এবং সমাজের সঙ্গে মিলে মিশে চলছেন। আর আবু ডাকাত ৮ বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।

র‌্যাব-৪ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা থেকে আজাদকে মিঠাপুকুর থানায় পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, “আজাদের সাজা ভোগ শুরু হবে গ্রেপ্তারের পর থেকে।“

জিজ্ঞাসাবাদে আজাদ র‌্যাব কর্মকর্তাদের বলেছেন, তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ১৯৯১ সালে ফাজিল পাস করেছেন। ২০১৪ সালে তার বাবা মারা যান। ২০০৭ সালে পরিচয় গোপন করে পাশের বদরগঞ্জ থানা এলাকায় তিনি বিয়ে করলেও তা টেকেনি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই মামলার বাদী মফিজ উদ্দিন মারা গেছেন। তার একমাত্র ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে। বাদীর এক মেয়ে থাকলেও তখন ছোট থাকায় সেই ঘটনা তেমন মনে নেই।

১৯৯২ সালে বর্তমানের মত প্রযুক্তি না থাকায় আজাদের ‘আত্মগোপনে’ থাকতে সুবিধা হয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান।

ওসি জাকির বলেন, “বাদীর কেউ না থাকলেও সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের আজীবন পালিয়ে থাকার সম্ভাবনা নেই।

“কারণ থানায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের তালিকা রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ থাকে। আর প্রতিবছর তা আপডেট করা হয়; হারিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।“