নতুনের কাণ্ডারীরা কীভাবে আসেন?

নিজের কাজ সুচারুভাবে শেষ করার দক্ষতা হয়ত অনেকেই রাখেন। ফলাফল যেমন হওয়ার কথা ছিল, দিন শেষে তেমনটাই হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2021, 08:26 PM
Updated : 22 Jan 2021, 09:09 PM

কেউ কেউ কাজটি করেন ভিন্নভাবে, তাতে সৃষ্টি হয় সম্পূর্ণ নতুন কিছু। তাদের সেই কাজ পুরনো অনেক রীতি-নীতি ভেঙে ফেলে, চিরাচরিত কর্মপদ্ধতিকে বদলে দেয়, জন্ম দেয় নতুন ধারণার। কখনও কখনও তা বিশ্বের সামনে খুলে দেয় এক নতুন বিশ্বে পদার্পণের পথ।

আজকের একজন তরুণ কীভাবে হয়ে উঠতে পারেন সেই নতুনের কাণ্ডারী? কীভাবে তিনি নতুন কিছুর নেতৃত্ব দিতে যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন?

তৌফিক ইমরোজ খালিদীর পরামর্শ হল, আগে নিজের কাজকে ভালোবাসতে হবে। কাজের প্রতি যখন ‘প্যাশন’ থাকবে, তখনই তৈরি হবে সৃষ্টিশীলতা। তখনই ভিন্ন কিছু করার, নতুন কিছু করার অনেক পথ খুলে যাবে সামনে।

অনেক প্রথমের জন্ম দেওয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী কথা বলছিলেন ‘ডিজরাপ্টিভ লিডারশিপ’ শিরোনামের ভার্চুয়াল এক আলোচনা অনুষ্ঠানে।

শুক্রবার রাতে ‘সাবলাইম লিডারশিপ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত এই আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন সাবলাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ মামুন খালেদ, যিনি বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের কমান্ড্যান্ট এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন এক সময়।

‘ডিজরাপ্টিভ লিডারশিপ’ কী, এ ধরনের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য কী, কেনই বা এ রকম একটি ধারণা নিয়ে এই আলোচনা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেখ মামুন খালেদ অনুষ্ঠানের শুরুতেই তা ব্যাখ্যা করেন।

আভিধানিক একটি অর্থে ‘ডিজরাপশন’ মানে হল, যা চেনা কাঠামোকে ভেঙেচুরে ফেলে। তবে আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে এটা এমন এক পরিবর্তন, যা মানুষকে নতুন করে ভাবায়; আরেকভাবে বললে, মানুষ যা কিছু করছে, তা নতুনভাবে করতে শেখায়।

ডিজরাপ্টিভ লিডার হচ্ছেন তিনি, যিনি সব সময় আরও ভালো সমাধানের এবং নতুনের পথ খোঁজেন। ভালো ফল প্রাপ্তির পথে বর্তমানকে নাড়িয়ে দিতে কিংবা ভেঙে দিতে ভাবিত হন না।

এই ধরনের নেতৃত্ব তার সঙ্গীদেরও নিজের কার্যক্রমে যুক্ত করেন এবং সমন্বিত সিদ্ধান্তে সুবিধাজনক সিদ্ধান্ত নেন।

শেখ মামুন খালেদ বললেন, তিনি যেটা ভালোবাসেন সেটাই করেন; আর যেটা করেন, সেটা ভালোবাসেন- এটাই সাফল্যের গোপন কথা।

‘ডিজরাপ্টিভ লিডারশিপ’ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার পর মামুন খালেদ আমন্ত্রণ জানান তৌফিক ইমরোজ খালিদীকে, যার নেতৃত্বে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে পৌঁছে দিয়েছে ইন্টারনেট যুগে । 

মামুন খালেদ জানতে চান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কীভাবে বাংলাদেশের ‘অন্যতম জনপ্রিয়’ নিউজ পোর্টালে পরিণত হল।

উত্তরে প্রধান সম্পাদক খালিদী বলেন, ‘অন্যতম জনপ্রিয়’ নয়, সত্যি কথা বলতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ‘সবচেয়ে জনপ্রিয়’ নিউজ পোর্টাল।

“আমরাই শুরুটা করেছিলাম, শুধু বাংলাদেশে নয়, খুব সম্ভবত আমরাই বিশ্বের প্রথম কেবল ইন্টারনেটভিত্তিক ‘ন্যাশনাল নিউজ গ্যাদারিং অপারেশন’।”

২০০৫ সালের প্রথমার্ধে যখন যাত্রা শুরু হল, তখন নাম ছিল শুধু ‘বিডিনিউজ’, পরিচয় ছিল একটি বার্তা সংস্থা, যারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য খবর সরবরাহ করে।

২০০৬ সালে বার্তা সংস্থাটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বদলের পর এর খোল-নলচে বদলে যায়। সাংবাদিক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর নেতৃত্বে নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের প্রথম ডটকম কোম্পানির রূপ দেয়। নতুন আঙ্গিকে এর পরিচয় হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নামে।

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, ‘বিডিনিউজ’ তখন ডুবতে বসা একটি কোম্পানি, তখনকার মালিকরা কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন।

“আমি যখন দায়িত্ব নিলাম, মূল বিষয় ছিল, কারও চাকরি যেন না যায়, আর কোম্পানির নামটা যেন থাকে। সবার চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা আমরা করেছি, কিন্তু নামটা আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমি এর নাম বদলে দিলাম, রি-ব্র্যান্ডিং করলাম, নাম দিলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। কার্যত এটাই বাংলাদেশের প্রথম ডটকম কোম্পানি।”

এরপর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর নতুন লোগো তৈরি এবং ওয়েবসাইটের পুরো নতুন একটি অবয়ব কীভাবে দেওয়া হল সেই গল্প শোনান খালিদী।

ওই বছর ২৩ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাত ধরেই বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়, সেটাই বাংলাদেশে কোনো বার্তা কক্ষের ২৪ ঘণ্টা সচল থাকার সূচনা লগ্ন।

এগিয়ে চলার পথে পরের ১৪টি বছরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বাংলাদেশে অনেক প্রথমের জন্ম দিয়েছে, যা পরে অনুসরণ করেছে অন্যান্য সংবাদমাধ্যম। 

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, এই পরিবর্তন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হোক, তা তিনি কখনও চাননি। তিনি চেয়েছেন এর উন্নয়ন করতে।

“আমি এ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে চাইনি, আমি এটাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছি, যা ছিল আমার প্রতিশ্রুতি।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর দুই ভাষায় সব পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন, সেই গল্প শোনানোর পাশাপাশি ইন্টারনেট সংবাদমাধ্যমের আয়ের উৎসের ক্ষেত্রে নতুন ‘বিজনেস মডেল’ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত মোবাইল ফোনে ব্রেকিং নিউজ সেবার কার্যক্রম চালু ও সাফল্যের কথা তিনি তুলে ধরেন।

অনেক প্রথমের জন্ম দিলেও গত ১৪ বছরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আর্থিকসহ নানা ধরনের সংকটের মধ্যে যেতে হয়েছে, সে কথাও প্রধান সম্পাদক এ অনুষ্ঠানে বলেন।

তিনি বলেন, “কিন্তু আমরা উদ্ভাবন বন্ধ রাখিনি। আমরা এমন কিছু করেছি, অন্য প্রতিষ্ঠান সেটা অনুসরণ করেছে।… আমাদের সাফল্য হচ্ছে আমরা প্রচুর সংখ্যায় ফলোয়ার তৈরি করতে পেরেছি।”

মামুন খালেদ জানতে চান, একজন ‘মডেল ডিজরাপ্টিভ লিডার’ হিসেবে তৌফিক ইমরোজ খালিদী আগামী দিনের তরুণ নেতাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “প্রথম বিষয় হল, তুমি যা করছ তা উপভোগ করছ কি না। তখনই আসবে কাজের প্রতি মনোযোগ। উপভোগ করতে যদি না পার, তাহলে সেই কাজ করতে যেও না।

“এরপর আসছে প্যাশনের কথা। তখন কাজের প্রতি তোমার প্যাশন তৈরি হবে, কারণ কাজটা তুমি উপভোগ করছ। আর তুমি যদি কাজের প্রতি প্যাশনেট হও তখনই তুমি কাজগুলো ভিন্নভাবে করতে চেষ্টা কর। তখন তুমি (আত্মবিশ্বাস নিয়ে) বলতে পারবে, ‘হ্যাঁ আমি এটা করেছি’। তার মানে তুমি মোটিভেটেড। তাতে যদি তুমি পুরনো নিয়ম ভেঙেও ফেল…”

এই নিয়ম ভাঙার প্রসঙ্গে নিজের অতীতের গল্প শুনিয়ে খালিদী বলেন, “আগে আমি একজন ডিজরাপ্টিভ পারসনই ছিলাম, কিন্তু কখনোই আমি আমার কাজ থেকে বিচ্যুত হইনি। যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি কাজ করেছি, সেই কোম্পানিকে ভালোবেসেছি, সেই প্রতিষ্ঠানকে ধারণ করেছি সব সময়।”

ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকরা হয়ত সব কাজ পছন্দ করেননি, কিন্তু কাজ করা কখনও থামাননি জানিয়ে তিনি বলেন, “কাজ করতে হবে, কাজটা ভালোবাসতে হবে, সেই কাজের প্রতি প্যাশন থাকতে হবে। তখন তুমি সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে, নিজের কাজটা করার অনেক পথ তুমি তখন খুঁজে পাবে।”

খালিদী বলেন, ‘ডিজরাপশন’ মানে এই নয় যে কেউ শৃঙ্খলা মানবে না। এর মানে হল কাজটা ভিন্নভাবে করা, নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে না থেকে সেটাকে চ্যালেঞ্জ করা।

বাংলাদেশে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তেলার জন্য আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সেভাবে নেই। তাহলে কীভাবে একজন তরুণ নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, সে বিষয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদীর পরামর্শ জানতে চান সঞ্চালক।

উত্তরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান গড়পড়তা নেতৃত্ব তৈরি করে। তেমন নেতৃত্বেরও প্রয়োজন আছে, তারাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ‘ডিজরাপ্টিভ লিডার’ বা ‘চেইঞ্জমেকাররা’ বেশিরভাগ সময় প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডি থেকে আসেন না। এ ধরনের নেতৃত্বের জন্য ‘বিশেষ কিছুর’ প্রয়োজন পড়ে।

সেই নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনে তরুণদের প্রতি খালিদীর পরামর্শ, “পড়, শেখো, নতুন কিছু অনুসন্ধান করো, পর্যবেক্ষণ করো এবং দেখো। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে এমন যেন মনে না হয় যে ‘আমি অনেক জেনে গেছি’। এটা কেউ বলতে পারে না। নতুন বিষয় পড়া, অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও দেখা কখনও বন্ধ করো না।”

আলোচনার শেষাংশে তৌফিক ইমরোজ খালিদী নিজেই প্রশ্নকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সঞ্চালক মামুন খালেদের পেশাগত জীবনে নানা প্রশিক্ষণ ও দায়িত্বের পাশাপাশি দেশ-বিদেশে দুটি এমবিএসহ মোট পাঁচটি মাস্টার্স ডিগ্রি এবং একটি ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ (ডিবিএ) তিনটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি জানতে চান, সেনাবাহিনীতে প্রায় ৪০ বছরের চাকরিতে থেকে এই অসামান্য অর্জন তিনি কীভাবে সম্ভব করলেন।

অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মামুন খালেদ উত্তরে বলেন, “আমি যেটা ভালোবাসি সেটা করি এবং যেটা করি সেটা ভালোবাসি। এটাই সিক্রেট।”