সারা জীবনের দুঃখ ঘুচে মিলছে তাদের মাথা গোঁজার ঠিকানা

“সারাটা জীবন শীতের সময়ে কাঁচা ঘরে ঘুমাতে পারতাম না। বৃষ্টি এলে ভিজে যেতাম। রোদ হলে পুড়তে হত। এই বছর শেখ হাসিনা আমাদের কষ্টের কথা চিন্তা করি পাকা ঘর করে দিয়েছেন বলে আর কোনো দিন সেই দুঃসহ কষ্ট সহ্য করতে হবে না।”

গোলাম মুজতবা ধ্রুব রংপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2021, 04:44 PM
Updated : 21 Jan 2021, 05:13 PM

নতুন একটি ঠিকানা পেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই প্রতিক্রিয়া জানালেন রংপুরের তারাগঞ্জের ফরিদাবাদ গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব যামিনী বালা, যিনি এই বয়সেও কৃষিকাজ করে জীবন চালান।

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে স্বামী হরেন্দ্রর সঙ্গে সংসার শুরু করা যামিনীর আজীবন স্বপ্ন ছিল সমাজের অন্যান্য নারীদের মতো তারও নিজের একটি ঘর হবে। তিন মেয়েকে নিয়ে সেখানে বসবাস করবেন তারা।

কিন্তু দারিদ্র্য কখনও পিছু ছাড়েনি, গড়াও হয়নি স্বপ্নের সেই ঘর। এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ঘর পেয়ে সেই দুঃখের অবসান হচ্ছে তার।

এই উপহারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ যামিনী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শেখ হাসিনা আমার সেই স্বাদ পূরণ করেছেন। তার জন্য আমি সব সময় দোয়া করব। তার নেক হায়াত চাইব।”

তার মতো মুজিববর্ষে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার’ হিসেবে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় জমির সঙ্গে ঘর পেতে চলেছেন ভূমিহীন-গৃহহীন হাজার হাজার পরিবার।

তার সন্তানকে এখন আর কেউ অবহেলা করতে পারবে না- এটাই স্বস্তির হয়ে উঠেছে দরিদ্র পিঠা ব্যবসায়ী ফজলে হকের। ছবি- পিএমও প্রেস উইং

বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য নির্মাণ করা ঘর পরিদর্শন করতে গিয়ে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সরকারের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে।

“আগামী শনিবার বিশ্বে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমির মালিকানা দিয়ে বিনা পয়সায় দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর মুজিববর্ষের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী প্রদান করবেন।”

এছাড়া ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলার ৪৪টি গ্রামে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

দেশজুড়ে বাস্তবায়নাধীন এই কর্মসূচির আওতায় রংপুর জেলার আটটি উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ২৮৮টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৯৮৫টিসহ মোট ১ হাজার ২৭৩টি বাড়ি করে দেওয়া হবে। শনিবার এমন ৮১৯টি ঘর ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান।

এসব ঘরের মধ্যে রংপুরের তারাগঞ্জ থানার সয়ার ইউনিয়নের ফরিদাবাদ গ্রামের বাসিন্দদের ৯০টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। আর পাশের গংগাচড়া উপজেলার ১০০টি পরিবার পেতে যাচ্ছে এই ঘর।

বৃহস্পতিবার সেখানে গেলে নতুন ঘর পেতে যাওয়া ভূমিহীনরা জানান,  এই ঘর তাদের জীবন বদলে দিচ্ছে। আগে সমাজে অনেকেই তাদের সম্মানের চোখে দেখতেন না, তারা কীভাবে বেঁচে আছেন সেই খোঁজটাও যারা রাখতেন না এখন তারাই তাদের ‘সম্মানের চোখে দেখছেন’।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আবদুল জব্বার বলছেন, শুধু মাথা গোজার ঠাঁই নয়, সমাজে তাদের ‘মানুষ হিসেবে সম্মান দিচ্ছে’ এই ঘর। ছবি- পিএমও প্রেস উইং

দীর্ঘ দিন ভিক্ষা করে জীবন চালানো তারাগঞ্জ থানার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আবদুল জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরাও যে এই সমাজেরই মানুষ সেটা এখন সবাই বুঝতে পারছে। আর এজন্য সবার আগে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য শেখ হাসিনা। শুধু তার কারণেই এখন আমাদের সবাই মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।

“আমিসহ যারা ভূমিহীন-গৃহহীন তারা শেখ হাসিনার কাছে আজীবন ঋণী হয়ে রইলাম।”

সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের পরিত্যক্ত ভবনে এক সময় ছোট শিশু কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করা পিঠা ব্যবসায়ী ফজলে হকও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তার কারণে আমার শিশু সন্তানটা নতুনভাবে বড় হতে পারবে। তাকে আর কেউ হতদরিদ্র বলে অবহেলা করতে পারবে না।”

গংগাচড়া থানার ভূমিহীন গৃহিণী বাতাসী বলেন, “আমার স্বামী কৃষি কাজ করেন। বিয়ের পর সন্তান হলে তাদের নিয়ে কাঁচা ঘরে এতদিন বসবাস করতে হয়েছে। শীত এলে বাচ্চারা রাতে প্রচণ্ড কষ্ট পেত। এখন সেই কষ্ট দূর হতে চলেছে।”

গংগাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলীমা বেগম জানান, এই উপজেলার নোহালি ইউনিয়নের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য ১৫টি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। অনেক যাচাই-বাছাই করে যারা প্রকৃতভাবে ভূমিহীন-গৃহহীন, তাদের এই ঘরগুলো দেওয়া হচ্ছে।

আশ্রয়ন প্রকল্পের নথি থেকে জানা যায়, ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আশ্রয়ন নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।

এবার মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তার এই ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে  ‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়।

এ লক্ষ্যে গত বছর জুনে সারা দেশে ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা করা হয়। আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় তাদের জীবন বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন এবং তাদের ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।