অধ্যাপক মোর্শেদকে চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে বিবৃতি

অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি গ্রুপ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2020, 07:00 PM
Updated : 15 Sept 2020, 07:00 PM

মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফার একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান, যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর রয়েছে।

জিয়াউর রহমানকে নিয়ে লেখায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির দায়ে মার্কেটিংয়ের শিক্ষক মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “গত  ৯ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সিন্ডিকেট সভায় মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মোর্শেদ হাসান খানের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা মনে করি, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি  বেআইনি এবং অন্যায় সিদ্ধান্ত। তাই আমরা এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং শিক্ষককে দ্রুত পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছি।”

বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতা অপর শিক্ষকরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান, প্রাচ্যকলা বিভাগের প্রভাষক দীপ্তি দত্ত, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, একই বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক মানস চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক নাসরিন খন্দকার, সহযোগী অধ্যাপক সায়েমা খাতুন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌভিক রেজা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আ. আল-মামুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর রাজী, সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক নাসির আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আরিফুজ্জামান রাজীব, সোয়াস- ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসরিয়াল রিসার্চ অ্যাসোশিয়েট স্বপন আদনান, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বার হাসান।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী যেসব কারণে একজন শিক্ষকের চাকরি যেতে পারে তার মধ্যে একটি হচ্ছে নৈতিক স্খলন আর অপরটি হচ্ছে শিক্ষক হিসেবে অযোগ্যতা (ধারা ৫৬/৩)। কিন্তু এর কোনোটিই অধ্যাপক মোর্শেদ হাসানের বরখাস্তের অভিযোগ হিসেবে দায়ের করা হয় নাই। উপরে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট যে, উনার চাকরিচ্যুতির মূল কারণ হচ্ছে উনার ভিন্ন রাজনৈতিক মত প্রকাশ।

“উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এই বরখাস্তের ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দেশজুড়ে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা নিয়ে যে তীব্র একটা অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে এটি তারই এক সাম্প্রতিক উদাহরণ। দেশের সর্বস্তরের মানুষই এ ধরনের অসহিষ্ণুতার শিকার হচ্ছেন। কাউকে কাউকে উঠিয়ে স্রেফ গুম করে দেওয়া হচ্ছে। যারা একটু সৌভাগ্যবান তাদের কেউ কেউ ফিরে আসছেন। আর গ্রেপ্তার-জেল সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।”

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ  এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, “যে বিষয়টি আমাদের শঙ্কিত করছে সেটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই নিপীড়নে সরকারি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনস্ত ছাত্র সংগঠনের অগ্রণী ভূমিকা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ছাত্রলীগের করা অভিযোগ বা মামলার পর বিশ্ববিদ্যালয় আরও উদ্যোগী হয়ে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। মোর্শেদ হাসানের নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং বিচার দাবি করে। এর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৎপর হয়।

“শুধু তাই নয়, এরপর ২০১৯ সালে ট্রাইবুন্যাল গঠনের পর দীর্ঘ এক বছরের উপর নীরবতার পর হঠাৎ করে এই মাসের ১ তারিখে  ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক সরকার সমর্থিত একটি ছাত্র সংগঠন যারা মূলত ছাত্রলীগের কর্মী ছিল, মোর্শেদ হাসানের স্থায়ী বহিষ্কার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় আবারও বিশ্ববিদ্যালয় তৎপর হয় এবং ৯ সেপ্টেম্বর  সিন্ডিকেটের সভায় অধ্যাপক মোর্শেদ হাসানকে স্থায়ী বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”

অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক ।

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় তার লেখা ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ।

এ ঘটনায় তাকে বরখাস্ত করার দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ওই লেখার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই বছরের ২ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

ওই কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হলে মোর্শেদ হাসান খানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আইনি সুপারিশ করতে গত বছর ৩০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

গত বছর ২৯ মে এক লিখিত সুপারিশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান তার লেখায় স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থি। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের পরিপন্থি। তিনি ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের পরে যে আন্দোলনের চিত্র এঁকেছেন তা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত বক্তব্যের পরিপন্থি। অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের বিতর্কিত লেখাটি সংবিধানের ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিলে বর্ণিত তথ্যের পরিপন্থি ও ইতিহাসের বিকৃতি।”

শাস্তির সুপারিশ করে ওই সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমার মতে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যরা যদি আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, সেক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতির বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে পুনরায় কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া যেতে পারে।”

ওই সুপারিশের পর বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনা ও শাস্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এএফএম মেজবাহউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি ‘বিশেষ ট্রাইবুন্যাল’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই ট্রাইবুন্যালে মোর্শেদ হাসান খানের পক্ষে সমন্বয় করতে সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফর রহমানকে রাখা হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে ওই ট্রাইবুন্যালে ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা মো. লিয়াকত হোসেন মোড়ল।

ওই ট্রাইব্যুনালের সুপারিশের ভিত্তিতে অধ্যাপক মোর্শেদকে চাকরি থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ নিবন্ধে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান লেখেন, “আওয়ামী নেতাদের বেশিরভাগই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদের পরিবার পরিজনসহ ভারতে চলে গেলেন এ দেশবাসীকে মৃত্যু ফাঁদে ফেলে দিয়ে নেতৃত্বহীন অবস্থায়। যাকে ঘিরে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখত সেই শেখ মুজিবুর রহমানও। জাতির এ সঙ্কটকালীন মুহূর্তে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত এই টগবগে যুবকের কণ্ঠে ২৬ মার্চ রাতে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর, তার আগে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।”

নিবন্ধের আারেক জায়গায় স্বাধীনতার পরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোর্শেদ হাসান লিখেছেন, “দেশবাসী দেখলো শেখ মুজিব একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা চালু করে নিজেই যেন দাঁড়িয়ে গেলেন নিজের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৭২ থেকে ৭৫-এর ১৫ অগাস্টের আগ পর্যন্ত দেশে বাক স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না।”

তার আগে ২০১৬ সালে ৩০ মে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ‘স্মৃতিময় জিয়া’ শিরোনামে এক লেখাতেও অধ্যাপক মোরশেদ হাসান খান একই ধরনের বক্তব্য দেন।

এই লেখা প্রকাশ করায় মোর্শেদ হাসান খান এবং নয়া দিগন্ত ও যায়যায়দিনের সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।