কোভিড-১৯ সেবায় না থাকলেও প্রণোদনা দিল দুই প্রতিষ্ঠান

মহামারী ঠেকানো কিংবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবার সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিতদের বিশেষ সম্মানীর পরিপত্রের আলোকে কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দিয়েছে দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2020, 07:06 PM
Updated : 6 August 2020, 05:36 AM

লকডাউনের মধ্যে অফিস করায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কর্মকর্তারা এই প্রণোদনা পেয়েছেন।

কমিশন সভা না করেই ‘অনৈতিকভাবে’ এই প্রণোদনা নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।

চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদের বাইরে অন্যদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের কোনো সার্কুলার না থাকায় কয়েকজন কর্মকর্তা প্রণোদনার অর্থ নেননি।

প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্মকর্তাদের প্রণোদনা হিসেবে এক থেকে দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হলেও নিচের শ্রেণির কর্মচারীদের তা দেওয়া হয়নি।

কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত সরকারি কর্মচারী দায়িত্ব পালনকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে গত ২৩ এপ্রিল পরিপত্র জারি করে অর্থ বিভাগ।

বেতন গ্রেড ভেদে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত এবং এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে একেক ধরনের ক্ষতিপূরণ পাবেন সরকারি চারকরিজীবীরা।

গত ৯ জুলাই অর্থ বিভাগ আরেক পরিপত্রে জানায়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সরকার এককালীন বিশেষ সম্মানী হিসেবে দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হবে।

এর বাইরে লকডাউনের মধ্যে যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা অফিস করেছেন তাদের প্রণোদনা দিয়েছে সরকার।

পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রণোদনা হিসেবে কাউকে দুই মাসের মূল বেতন, আবার কাউকে এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়েছে। টাকার পরিমাণ কম-বেশি হওয়ায় বিষয়টি বাইরে এসেছে, নইলে সবকিছু গোপনই থাকত।”

পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ

কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নিজেও এই প্রণোদনার অর্থ নিয়েছেন দাবি করে ওই কর্মকর্তা বলেন, কমিশন সভা করে প্রণোদনার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এই প্রণোদনার বিষয়ে কমিশনের সদস্যরা জানেন না। কারণ এই প্রতিষ্ঠান এভাবে প্রণোদনা দিতে পারে না।

“যারা প্রণোদনার টাকা নিয়েছেন, তারা কীভাবে সেই টাকা পেয়েছেন তার কোনো উত্তর দিতে পারছেন না। ফলে টাকা গ্রহণকারীরা বিষয়টি অনেক দিন গোপন রেখেছেন। লকডাউনের মধ্যে অনেক কর্মচারীকে নিয়মিতভাবে অফিস করতে হলেও তাদের কাউকেই প্রণোদনা দেওয়া হয়নি।”

কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তাদের প্রণোদনার টাকা তোলার কথা বললেও তারা নৈতিকতার প্রশ্নে তা তোলেননি। কোরবানির ঈদের আগে এই প্রণোদনা দেওয়া হলেও বার বার তাগাদার পর কয়েকজন ঈদের পর টাকা তুলবেন বলে জানিয়েছিলেন।
 
পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদের এই প্রণোদনার টাকা দেওয়া হয়নি বলে তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন বেনামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে একজন কর্মচারী জানিয়েছেন।

প্রণোদনার এই অর্থ নিয়ে অধিক আপত্তি উঠলে তা ফেরত দিতে হবে, এমন লিখিত প্রতিশ্রুতি নিয়েই এই টাকা দেওয়া হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

লকডাউনের মধ্যে অফিস করায় পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কতজন কর্মকর্তাকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হক স্বীকার করেছেন, হিসাব শাখাসহ আরও কিছু কর্মকর্তাকে প্রণোদনা হিসেবে টাকা দেওয়া হয়েছে।

বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “মেডিকেল যন্ত্রপাতি আনতে আমরা লাইসেন্স দেই, লকডাউনের মধ্যে অনেকেই এনিয়ে কাজ করেছেন। ওই সময় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ নিয়ে কাজ করতে হয়েছে, হিসাব শাখার লোকজন কাজ করেছেন বলে তাদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।”

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার অনুযায়ী পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা প্রণোদনা পান কি না- সেই প্রশ্নে মোজাম্মেল হক বলেন, “আমরা ওই সার্কুলার ধরে প্রণোদনা নেইনি, ওই সার্কুলারের আলোকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।”

নিজের প্রণোদনা গ্রহণ নিয়ে কোনো কথা বলেননি পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান।

পরমাণু শক্তি কমিশন

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সদস্য (পরিকল্পনা) মো. আজিজুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্তে কিছু কর্মকর্তাকে প্রণোদনা হিসেবে টাকা দিয়েছেন। কোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট মেইনটেইন করা হয়নি।”

কমিশন সভা করে এই প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, কমিশনের সদস্য হিসেবে তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।

এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সানোয়ার হোসেনকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইতি রাণী পোদ্দারকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে কি না, তিনি তা জানেন না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে কেউ অভিযোগও করেনি।