‘সীমিত পরিসরে’ যেমন চলছে সচিবালয়

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে সীমিত পরিসরের অফিসে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ঢিলেঢালাভাবে কাজ চললেও কয়েকটিতে কাজের পরিধি বেড়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2020, 04:37 AM
Updated : 13 July 2020, 04:50 AM

কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে একসঙ্গে ২৫ শতাংশের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো মন্ত্রণালয়েই আসছেন না; কাজ কম হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু ফেলে রাখা হচ্ছে না।

স্বাভাবিক সময়ে অফিস চলাকালীন এমন ফাঁকা করিডোর সচরাচর দেখা যায় না। ছবি: শহীদুল ইসলাম

রোববার সকাল থেকে সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে দেখা যায়, যেসব কক্ষে চার-পাঁচজনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে দু’একজন কাজ করছেন। রোস্টার করে অফিস করতে হচ্ছে বলে অনেক কক্ষেই তালা ঝুলছিল।

কয়েকটি মন্ত্রণালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রবেশ পথে জীবাণুনাশক টানেল বসিয়েছে। কোনো কোনো ভবনের প্রবেশ পথে রাখা হয়েছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। জুতা পরিষ্কার করে ঢোকার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে।

শ্রম ও কর্মস্থংস্থান মন্ত্রণালয়ের মতো বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে তাদের মন্ত্রণালয়ের ঢোকার মুখে এমন জীবাণুনাশক টানেল বসিয়েছে। ছবি: শহীদুল ইসলাম

কিছু কিছু কক্ষের সামনে কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রেখেছেন। লিফটগুলোর সুইচে মাঝেমাধ্যে জীবাণুনাশক স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে।

কিছু কর্মকর্তা তাদের কক্ষের সামনে নোটিস ঝুলিয়ে অপ্রয়োজনে কাউকে কক্ষে না ঢোকার অনুরোধ করেছেন। কেউ কেউ রশি টাঙিয়ে দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

ঢিলেঢালাভাবে কাজ চলায় কিছু কিছু মন্ত্রণালয় এই সুযোগে আসবাবপত্র মেরামতসহ অবকাঠামোগত অন্যান্য কাজে হাত দিয়েছে।

কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করতে হলে জীবাণুনাশক টানেলের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। ছবি: শহীদুল ইসলাম

৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, সেতু বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অফিস সচিবালয়ের বাইরে। অন্যসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অফিসে সচিবালয়ের ভেতরে।

গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস চালু করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করা হলেও জরুরি কাজের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রণালয়গুলো তখনও স্বল্প পরিসরে খোলা ছিল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রবেশের একদিকের সিঁড়ির সামনে বসানো হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। ছবি: শহীদুল ইসলাম

আগামী ৬ অগাস্ট পর্যন্ত সীমিত পরিসরে অফিস চলবে। এরপর থেকে কীভাবে অফিস চলবে, সে বিষয়ে আদেশ জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এই সীমিত পরিসরের অফিসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজ ‘অবশ্যই কিছুটা কমেছে’ বলে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন স্বীকার করেছেন।

তিনি রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ অনেক কমেছে, কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের কাজ আবার বেড়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় জুতা জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছে। ছবি: শহীদুল ইসলাম

“স্বাস্থ্য, অর্থ এবং জনপ্রশাসনসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কাজ বেড়েছে। বৈদেশিক যোগাযোগ সংক্রান্ত কাজগুলো যারা করেন তাদের কাজ কমেছে, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ বেড়েছে।”

সচিব ইউসুফ হারুন জানান, সরকারের নির্দেশনা মেনে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী একসঙ্গে অফিসে এসে কাজ করছেন। বয়স্ক, অসুস্থদের পাশাপাশি গর্ভবতী নারীরা এখন অফিসে আসছেন না।

“সীমিত পরিসরে অফিস চললেও জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ কিন্তু ফেলে রাখা হচ্ছে না। কেউ এসব কাজ ফেলে রাখলে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ ফেলে রাখলে যদি জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তা মেনে নেওয়া হবে না।”

লিফটগুলোর সুইচে জীবাণুনাশক স্প্রে করে সেগুলো জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। ছবি: শহীদুল ইসলাম

কাজ কমে যাওয়ায় কম সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কাজ চালিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেন জনপ্রশাসন সচিব।

“২৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী একসঙ্গে উপস্থিত থেকে এখন কাজ চালিয়ে নিতে কোনো মন্ত্রণালয়েই কোনো সমস্যা হচ্ছে না, এই জনবল দিয়েই এখন কাজ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।”

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি অনুবিভাগ) সোলতান আহ্‌মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের ফুলফিল কাজ চলছে, কাজ আগের থেকে বেড়েছে। সিনিয়র কর্মকর্তারা নিয়মিত অফিস করছেন।

“অন্য যেসব কর্মকর্তা আছেন তারা যদি বাসায় বসে অনলাইনে তাদের কাজ করে দিতে পারেন তাহলে তাদের অফিসে আসতে নিষেধ করা হচ্ছে, এভাবেই কাজগুলো চলছে।”

সচিবালয়ে পায়ে হেঁটে চলাচলের পথগুলোতে জীবাণুনাশক স্প্রে করছেন সিটি করপোরেশনের এককর্মী। ছবি: শহীদুল ইসলাম

মন্ত্রিপররিষদ বিভাগ থেকে মাঠপ্রশাসনকে সমন্বয় করতে হয় বলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে এই বিভাগের কাজ বেড়েছে বলে জানান অতিরিক্ত সচিব সোলতান।

অফিস সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কিছু কক্ষে তালা ঝুলতে দেখা গেলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবগুলো দপ্তরেই কর্মকর্তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়।

এই মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের তো তালগোল অবস্থা, কাজ অনেক বেড়ে গেছে। এখন দিনরাত নেই, যখনই প্রয়োজন তখনই কাজ করছি।”

কোনো কোনো কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে নিজের কক্ষের সামনে রেখেছেন হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা। ছবি: শহীদুল ইসলাম

কোন অনুবিভাগ কোন দিন খোলা থাকবে, সেই সূচি নির্ধারণ করে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।

অনুবিভাগগুলো খোলা রাখার দিন দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কারা অফিসে আসবেন হবে তা দপ্তরপ্রধানদের ঠিক করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেছেন, মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ আগের থেকে বেড়েছে।

রোস্টার করে অফিস করতে হচ্ছে বলে অনেক কক্ষেই তালা ঝুলছে। ছবি: শহীদুল ইসলাম

এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারী এবং বন্যাক্রান্তদের জন্য ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ বেড়েছে।

কৃষি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়েকেও মহামারীতে বাড়তি কাজ করতে হচ্ছে বলে এসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।

এতদিন তেমন কোনো কাজ না থাকলেও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানো নিয়ে বেশকিছু কাজ করতে হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ঢিলেঢালা অফিস চলছে বলে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের করা হচ্ছে মেরামত কাজ। ছবি: শহীদুল ইসলাম

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ফরিদা পারভীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাজ কমেছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে কাজের ধরন পাল্টেছে।

“আগে যে কাজগুলো আমরা সচিবালয়ে গিয়ে করতাম, এখন সেগুলোর বেশিরভাগ ভার্চুয়ালি করা হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা মেনে একসঙ্গে ২৫ শতাংশের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে উপস্থিত হচ্ছেন না।”

নাম, পদবি ও কোন দপ্তরে কাজ করেন সেসব তথ্য প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক মন্ত্রণালয়েরই এখন কাজ নেই, কিন্তু তারা মুখে স্বীকার করবে না। কারণ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে প্রতিদিন অফিসে করতে হচ্ছে এবং তারা কোনো না কোনো কাজ দেখানোর চেষ্টা করছেন, আসলে এসব কোনো কাজই না।”

সীমিত পরিসরে অফিসে একসঙ্গে ২৫ শতাংশের বেশি কর্মকর্তাকে অফিস করতে হচ্ছে না বলে সচিবালয়ের ভেতরে এখন গাড়ির পার্কিং নিয়ে খুব বেশি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে না। ছবি: শহীদুল ইসলাম

মহামারী ঠেকাতে সীমিত পরিসরে অফিস চললেও এই পর্যন্ত অন্তত ছয়জন সচিব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।