ডেঙ্গু: ডিএনসিসির নানা উদ্যোগে ‘সুফল’ দেখছে স্বাস্থ্য বিভাগ

গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এবার নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, যার সুফলও আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2020, 11:56 AM
Updated : 7 July 2020, 11:56 AM

চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় কম। বছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যুর তথ্য সরকারের নথিভুক্ত হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহিত রোগ নিমূল কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আফসানা আলমগীর খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর এখন পর্যন্ত ডিএনসিসির মশক নিধন কার্যক্রম সন্তোষজনক মনে হয়েছে আমাদের। জনগণের অংশগ্রহণ এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে।”

মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু গতবছর বাংলাদেশের মাথাব্যথার বড় হয়ে উঠেছিল। সরকারি হিসাবে, পুরো বছরে ১ লাখের বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, মৃত্যু হয়েছিল ২৭৬ জনের।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য নগরবাসীর সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। এমনকি দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়নেও বিষয়টি প্রভাব ফেলে।   

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, মশক নিধন কার্যক্রম সফল করতে এবার বছরের শুরু থেকেই জনসচেতনতায় জোর দিয়ে আসছেন তারা।

আর এই কাজে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। মাইকিং, লিফলেট, পোস্টার, স্টিকার বিলিসহ ডিজিটাল প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম শুরু করে ডিএনসিসি। এইডিস মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করে তা নিশ্চিহ্ন করতে জুন থেকে শুরু হয়েছে ‘চিরুনি অভিযান’।

ডিএনসিসির পাঁচটি নগর মাতৃসদন এবং ৩৫টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে ১৭৫টি পরীক্ষা করে ৭ জন রোগী শনাক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মশক নিধন কার্যক্রমে গত বছরের অভিজ্ঞতা এবার কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে তিনি ১২ জন কীটতত্ত্ববিদের একটি দল করেছেন। সেই সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

“কোন জায়গায় মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে সেটা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন অ্যান্টোমলজিস্ট এবং সিডিসির কর্মীরা। সেসব জায়গায় আমরা ওষুধ ছিটাচ্ছি। সেই সঙ্গে চিরুনি অভিযানও আমরা অব্যাহত রেখেছি। সামনের মাসেও চলবে এ অভিযান।”

সারাবছরই মশক নিধন কার্যক্রম তদারকির ব্যবস্থা রেখে তাতে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগের কথা জানিয়ে আতিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা মশককর্মীদের হাজিরা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেব স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে। তারা মশককর্মীদের কার্যক্রম দেখে আমাদের জানাবেন। এতে কাজটি ঠিকমত হচ্ছে কি না নিশ্চিত হওয়া যাবে।"

কর্মকর্তারা জানান, মশক নিধনে ব্যবহৃত ওষুধে মশা মরছে না- এমন অভিযোগ ওঠার পর গত বছরই কীটনাশক বদলে ফেলেছে ডিএনসিসি। আগের ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহিত রোগ নিমূল কর্মসূচির ডা. আফসানা জানান, এবার তারা এখনও বর্ষাকালীন জরিপ শুরু করেননি। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে জরিপপূর্ব পরিদর্শন কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

“ডিএনসিসি এবার আগেভাগেই মশা নির্মূলে চিরুনি অভিযানসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। আমাদের কর্মসূচির সঙ্গেও উনারা যুক্ত হয়েছেন। এসব উদ্যোগের সুফল কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। আমরা তো প্রায় সব বাসাতেই যাচ্ছি। মশার উপস্থিতি আগেরবারের চেয়ে কম মনে হয়েছে। মানুষজনও আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন।”

তবে ঢাকা দক্ষিণে এবার কোনো জরিপ বা পরিদর্শন কার্যক্রম এখনও চালায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে দক্ষিণ সিটির পরিস্থিতি নিয়ে অধিদপ্তরের মূল্যায়ন জানা যায়নি।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার সার্বিকভাবেই কমেছে। 

২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে যেখানে সারা দেশে ২ হাজার ২০৮ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ৯ জন মারা গিয়েছিলেন, সেখানে এ বছর জুন পর্যন্ত মোট ৩২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন; এ পর্যন্ত কেউ মারা যাননি।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে আক্রান্তের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে কমেছে। জানুয়ারিতে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন এবং জুনে ২০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

২০১৯ সালে সারাদেশে ১ লাখ ১ হাজার ২৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন; এর মধ্যে ঢাকায় ৫১ হাজার ৪৮৩ জন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত ২৭৬ জনের মধ্যে ঢাকার ২০৭ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ হিসাব তৈরি করা হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। ঢাকার কোন সিটিতে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, আলাদাভাবে সে হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই।

জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এইডিসবাহিত রোগ নিমূল কর্মসূচির আওতায় ২০১৯ সালের ৩ থেকে ১২ মার্চ ১০ দিন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৭টি ওয়ার্ডের ১০০টি জায়গায় জরিপ চালানো হয়।

সে জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৫টি এবং উত্তর সিটির সাতটি ওয়ার্ডে এইডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছিল।

এ বছর নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বর্ষাকালীন জরিপ এখন পর্যন্ত চালায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে জরিপ পূর্ববর্তী পরিদর্শন চালিয়েছে। তাতে এইডিস মশার উপস্থিতি গত বছরের চেয়ে কম মনে হয়েছে কর্মকর্তাদের কাছে।

নগরবাসীকে ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা দিতে এ বছরের ৬ জুন থেকে ৫৪টি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান চালায় ডিএনসিসি। ১০ দিন ধরে চলা ওই অভিযানে ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৩৫টি বাড়ি, স্থাপনা, নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করা হয়। তার মধ্যে ১ হাজার ৬০১টি স্থাপনায় এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এছাড়া ৮৯ হাজার ৬২৬টি স্থাপনায় এইডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পায় ডিএনসিসির কর্মীরা।

৫ জুলাই শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফার অভিযানের প্রথম দুই দিনে ২৫ হাজার ৯১৮টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৯০টি বাড়িতে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এইডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া গেছে ১৬ হাজার ৫৫৮টি স্থাপনায়।

প্রথম দফার চিরুনি অভিযানে ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং দ্বিতীয় দফার দুই দিনে ৪ লাখ ৫২ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে ডিএনসিসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।