প্রত্যাহার হচ্ছেন কুড়িগ্রামের সেই ডিসি

গভীর রাতে এক সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জেল-জরিমানা দেওয়ার ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2020, 08:39 AM
Updated : 16 March 2020, 08:38 AM

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ওই ঘটনার তদন্ত করে ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

রোববার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “তাকে প্রত্যাহার করা হবে। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। কর্ম অনুযায়ী তার শাস্তি হবে।”

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সংশ্লিষ্ট ফাইল অনুমোদন করলে ডিসিকে প্রত্যাহারের আদেশ জারি করা হবে বলে জানান ফরহাদ।

তিনি বলেন, “তদন্তে অনেকগুলো অনিয়ম দেখেছি। বিভাগীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। অহেতুক যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে... সত্যতা পেয়েছি বিধায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুলতানা ২০১৮ সালের ৩ মার্চ থেকে কুড়িগ্রাম জেলার ডিসির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কারের পর তিনি নিজের নামানুসারে ওই পুকুরের নাম ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দশ মাস আগে।

এরপর বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে শুক্রবার গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক রাখার অভিযোগে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ওই অভিযান পরিচালনা করেন। গভীর রাতে সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাজা দেওয়ার ঘটনায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ডিসির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করেন অনেকে।

সুলতানা পারভীন

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারকে এই ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম তদন্তের দায়িত্ব দেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানাকে।

এদিকে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সুজাউদ্দৌলা রোববার সাংবাদিক রিগানের জামিন মঞ্জুর করেন। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাদণ্ড দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদনও করা হয়।

রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব; জনপ্রশাসন সচিব ও এপিডিসহ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।

পরে ব্রিফিংয়ে এসে তিনি বলেন, খসড়া তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ডিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। স্বাক্ষরিত মূল প্রতিবেদনটি ‘কিছুক্ষণের মধ্যে’ এসে পৌঁছাবে।

“তদন্তের মধ্যে আমরা বেশ অনেকগুলো অনিয়ম দেখেছি। অনেকগুলো অসঙ্গতি পেয়েছি এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছি। তার (ডিসি) বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিউর অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ইতোমধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি।”

ডিসি সুলতানার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তার অনেকগুলোর ‘সত্যতা মিলেছে’ জানিয়ে ফরহাদ বলেন, “ওখানে যারা আছেন, কাজ করেছেন। আমাদের পুরোপুরি তদন্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি অনিয়মের জন্য কে কী রকম রোল প্লে করেছেন, সেই রোলটি যদি নিজের চিন্তা-ভাবনা মতে করে থাকেন আইন বহির্ভূতভাবে, অবশ্যই সে দোষী সাব্যস্ত হবে।”

ফরহাদের ভাষ্য, অধীনস্তরা সাধারণত তাদের ‘বসের’ নির্দেশনায় কাজ করেন। যারা অধীনস্ত ছিলেন তাদের কাজে কোনো গাফিলতি ছিল কি না- তা খতিয়ে দেখা হবে।

“এ ঘটনায় ইতোমধ্যে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সাংবাদিক আরিফুল মুক্ত হয়েছেন। আমরা এখন চেষ্টা করছি, সরকারি যে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াটা আমাদের জন্য অপরিহার্য। সেই বিষয়গুলোর জন্য আমরা এগুচ্ছি।”

শুধু জেলা প্রশাসকের পদ থেকে প্রত্যাহার নয়, ‍সুলাতানার বিরুদ্ধে ‘সব ধরনের পদক্ষেপই’ নেওয়া হবে বলে জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।

দিনি বলেন, “এটার জন্য আমাদের আরেকটু বসতে হবে, কারণ একেবারে বিধিসম্মতভাবে করতে হবে। আমি আশ্বস্ত করছি, কর্ম অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, বিচার না হলে তো আমরা বলতে পারে না তার কি হবে। এটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু তিনি ইতোমধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন, সেজন্য আমরা অবশ্যই কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছি।”

সাংবাদিকে আরিফের কী হবে, সেই প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সাজা হয়েছে, আটকও হয়েছিলেন। অবশ্যই আমাদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসবে। এগুলো তো আমাদের তদন্তের মধ্যে অনেক কিছু পেয়ে গেছি। লড়তে গেলে তদন্তের রিপোর্ট তো সেখানে পেশ করা হবে।

“অতএব বিচারের সময় আমরা যখন দেখব যেগুলো হয়েছে সত্য প্রমাণিত হয়নি, তখন যেটা হওয়ার সেটাই তো হবে, সে তো সেইভ হয়ে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আমরা খুব দ্রুত কাজ করছি এবং দৃষ্টান্তমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা যা করা উচিত সেটাই হবে।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রশাসন যাতে মানুষের কল্যাণে কাজ করে সেজন্য ‘শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার’ নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে।

“আপনারা আশ্বস্ত থাকতে পারেন, বিচারের মধ্য দিয়ে যদি সে দোষী সাব্যস্ত হয় তার সর্বোচ্চ সাজা হবে।”

এই ঘাটনার মধ্য দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হল কি না- সেই প্রশ্নে ফরহাদ হোসেন বলেন, মোবাইল কোর্টটা ‘অত্যন্ত জরুরি’, কারণ তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়া যায়।

“রমজান মাস আসছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো থেকে শুরু করে নানান রকম ঘটনা ঘটে, ভেজাল জিনিস বিক্রি করে, সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত অত্যন্ত উপযোগীভাবে কাজ করে। কেউ কোনো অনাচার, করছে, কোনো কিছু করছে সেটাও কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে (বিচার) হয়। আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে অবশ্যই বিষয়টি মাথায় রেখেছি।

“আমরা এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ের সমস্ত কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে বলে দিয়েছি, যাতে বিতর্ক সৃষ্টি না হয়। তার ভুলের কারণে যদি কোনো কিছু হয় তবে তাকেই শাস্তি পেতে হবে।”

ডিসি সুলতানার বিরুদ্ধে কী কী অনিয়মের অভিযোগ এসেছে জানতে চাইলে ফরহাদ বলেন, “রাতে এই মোবাইল কোর্ট করা যায় কি না, প্রথম কো হচ্ছে এটা। এ রকম বেশ কিছু বিষয় আছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিষয় এসেছে, সেজন্য আমরা আলাদা তদন্ত করব।”

মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সময়ও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ছিল- এমন খবরের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সেটাও আমরা খতিয়ে দেখব। রাইট ম্যান রাইট প্লেসে দেওয়ার যে নীতি আমরা গ্রহণ করেছি, সেক্ষেত্রে ডিসি কিন্তু অত্যন্ত চিন্তাভাবনা করে নিয়োগ দিয়ে থাকি।

“তার আগের স্টেশনে যদি তার দুর্নাম বা কিছু থেকে থাকে, তিনি কীভাবে ডিসি নিয়োগ হলেন, ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিউরের সময় সব উঠে আসবে এবং সেগুলো বিবেচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, “আমাদের পাঁচ-ছয় হাজার কর্মকর্তা। এর মধ্যে দুই একজন খারাপ হতে পারে। যখন আমরা নিয়োগ দিই তখন তো দুয়েকটি ভুল হতেই পারে।”

কর্মকর্তাদের অতীত কর্মকাণ্ড বিচার-বিশ্লেষণ করেই জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় জানিয়ে সচিব বলেন, “দুই একজন কর্মকর্তার অনিয়মের দায়ভার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কখনোই গ্রহণ করে না।”