দুদকের খড়গ বিরোধীদের উপর: টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পর্যবেক্ষণ, দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারবিরোধীদের উপর খড়গহস্ত হলেও ক্ষমতাসীনদের বেলায় নমনীয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2020, 11:31 AM
Updated : 25 Feb 2020, 12:21 PM

‘দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ উদ্যোগ- বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের উপর একটি ফলো আপ গবেষণা’ প্রতিবেদনে একথা বলেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে দুদকের দক্ষতার ঘাটতির বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

টিআইবি আরও বলেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ‘জিরো টলারেন্সের’ কথা বলা হলেও সরকারি কোনো কোনো উদ্যোগের মাধ্যমে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।

২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের পর মঙ্গলবার ঢাকার মাইডাস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দুদকের ক্ষমতা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী দলের রাজনীতিকদের হয়রানি করা এবং ক্ষমতাসীন দল-জোটের রাজনীতিকদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে দুদকের বিরুদ্ধে।”

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী অবস্থান যাদের, তাদের ব্যাপারে দুদক বেশি সক্রিয়। সরকারপক্ষে সেভাবে দুদক সক্রিয় নয়।

“মাঝেমধ্যে দুদক সরকারি দলের এমপিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন। ওই পর্যন্তই। এরপর আর কোনো কিছু দেখা যায় না।”

বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, বিরোধী দলকে দমনে দুদককে ব্যবহার করছে সরকার। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা সেই অভিযোগ নাকচ করে বলছেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুদকের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়।

“দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, তার বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি খুব যে হয়েছে, তা বলা যাবে না। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে মানুষের আস্থার ঘাটতি রয়েছে। এর সুফল নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।”

ঢাকার ধানমণ্ডিতে মাইডাস সেন্টারে মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

টিআইবির কার্যক্রম নিয়ে নানা সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা এমনও বলেছেন, টিআইবি ‘বিএনপির সুরে’ কথা বলছে।

দুর্নীতির মামলায়  বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাজার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জিয়া ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাও টিআইবির এই বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

“খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাটি নিয়ে কোনো কিছু বলা আমাদের এখতিয়ারে নেই।”

টিআইবির প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে প্রণীত সরকারি চাকরি আইনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে, দুদক কোনো অভিযোগে সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পূর্বানুমতি নিতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমরা শুনেছি, এই চাকরি নীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে ও দুদকও সক্ষমতার ঘাটতির পরিচয় দিয়েছে। এ নীতি বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক।

“এতে দুদকের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দুদক তার নিজস্ব ধারণাপ্রসূত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বিরত থাকে। আমরা আশা করি, এ নীতি আদালত কর্তৃক প্রত্যাহার হবে।”

ঢাকার ধানমণ্ডিতে মাইডাস সেন্টারে মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

স্বাধীনতা ও মর্যাদা; অর্থ ও মানবসম্পদ; জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচার; অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়ের; প্রতিরোধ, শিক্ষা, আউটরিচ কার্যক্রম; সহযোগিতা ও বাহ্যিক সম্পর্ক- এই ৬টি ক্ষেত্রের অধীনে ৫০টি নির্দেশককে ভিত্তি করে গবেষণাটি চালিয়েছে টিআইবি।

৫০টি নির্দেশকে দুদকের নানা কার্যক্রম বিবেচনায় স্কোরিং করেছে টিআইবি।  সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ স্কোর পেয়েছে ‘প্রতিরোধ-শিক্ষা-আউটরিচ কার্যক্রম,  স্বাধীনতা ও মর্যাদা পেয়েছে ৬৭ শতাংশ স্কোর, সহযোগিতা ও বাহ্যিক সম্পর্ক ক্ষেত্র পেয়েছে ৬৭ শতাংশ স্কোর। সর্বনিম্ন ৪৪ শতাংশ স্কোর পেয়েছে অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্র।

গবেষণার ফলাফল নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনারদের সঙ্গে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বৈঠকও করেছে সংস্থাটি।

২০১৬-১৮ সালে মোট ৪৭ হাজার ৫৪৯টি অভিযোগের মধ্যে দুদক ৩ হাজার ২০৯টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে, যার শতকরা হার ৬.৭৫ শতাংশ। (আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ৬৬ শতাংশের বেশি)।

দুদকের অভিযোগ বিবেচনায় নেওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটি কঠোর বলে উঠে এসেছে টিআইবি প্রতিবেদনে। টিআইবি বলছে, দুদকের মতে অধিকাংশ অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না।

দুদকের দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের প্রশ্নে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেন ও দায়িত্বে অবহেলার  অভিযোগ এসেছে। দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করার জন্য আইনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছে। মামলা দায়ের ও শাস্তির হার বিবেচনায় দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত এখনও মানসম্মতভাবে দক্ষ ও পেশাদার নয়।

২০১৬-১৮ সময়কালে দুদক ৪ হাজার ৩০৮টি অনুসন্ধানের মধ্য থেকে ৮৪৮টি মামলা (শতকরা ২১ ভাগ) করে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ৭৫ শতাংশের বেশি।

২০১৬-১৮ সময়কালে দুদকের মামলায় গড় দণ্ডাদেশের হার ছিল ৫৭.৭ শতাংশ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ৭৫ শতাংশের বেশি।

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণের (২০১৫ সালে ৫৯০ কোটি মার্কিন ডলার) প্রেক্ষিতে দুদকের উদ্ধারকৃত অর্থের পরিমাণ (জরিমানা ও আটক হিসেবে ২০১৮ সালে ১৫৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা)  উল্লেখযোগ্য নয়।

সংস্থাটি বলেছে, ২০১৬ সালে পরিচালিত গবেষণার সুপারিশের ভিত্তিতে দুদকের বাজেট বাড়লেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদকের নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী অনুমোদন ও কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নিয়োগ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ জানানোর জন্য হটলাইন ১০৬ চালু করা হলেও অভিযোগের বড় অংশের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। 

টিআইবি বলছে, “বিভিন্ন দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠানের উপর প্রতিবেদন তৈরি ও সুপারিশ করলেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন নিশ্চিৎ করার ক্ষমতা দুদকের নেই।”

দুদকের নানা সমস্যা সমাধানে টিআইবি দিয়েছে নানা সুপারিশ।

এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগের আগে গণশুনানির আয়োজন করা, দুদকের কাজ তদারকিতে যোগ্যতাসম্পন্ন জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে স্বাধীন কমিটি গঠন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানের সংখ্যা বাড়ানো, দুদকে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ ও দক্ষ জনবল বাড়ানো।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কোনো কোনো সূচকে দুদকের অগ্রগতি হলেও সার্বিক অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুদক কাগজে কলমে স্বাধীন বটে, কিন্তু বাস্তবে নয়। দুদকের সক্ষমতারও ঘাটতি রয়েছে।

“দুদককে যেতে হবে অনেক পথ।”