ধর্মঘটে লঞ্চ বন্ধ দক্ষিণ জনপদে

ঢাকা সদরঘাট থেকে কিছু লঞ্চ ছেড়ে গেলেও নৌ শ্রমিকদের ধর্মঘটে দক্ষিণ জনপদের জেলাগুলো থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2019, 07:19 AM
Updated : 30 Nov 2019, 12:49 PM

নিয়োগপত্র ও খাবার ভাতাসহ ১১ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের এই ধর্মঘটের কারনে বরিশাল, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলার নৌপথের যাত্রীরা পড়েছেন ভোগান্তিতে।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে শুক্রবার রাত ১২ টা ১মিনিট থেকে শুরু হওয়া এই ধর্মঘটের ফলে মোংলা বন্দরে জাহাজে পন্য ওঠানামার কাজও ব্যাহত হচ্ছে।

নৌ শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মধ্যে শনিবার ঢাকা সদরঘাটের চিত্র।

ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে ১১ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করে আসছি। লঞ্চ মালিকপক্ষ শুধু আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করেনি। গত বুধবারও সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বসেছিলাম, কিন্তু আবারও আশ্বাস। তাই শ্রমিকরা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধর্মঘটে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেওয়ায় আমরা ধর্মঘট শুরু করেছি।”

ফেডারেশনের দাবিগুলো হলো ১. বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি বন্ধ করা ২. ২০১৬ সালে ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী নৌযানের সর্বস্তরের শ্রমিকদের বেতন দেওয়া ৩. ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস এবং মালিক কর্তৃক খাদ্য ভাতা দেওয়া ৪. সব নৌযান শ্রমিকের সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ ৫. এনডোর্স, ইনচার্জ, টেকনিক্যাল ভাতা পুনর্নির্ধারণ ৬. কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ ৭. প্রত্যেক নৌশ্রমিককে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক দেওয়া ৮. নদীর নাব্য রক্ষা ও প্রয়োজনীয় মার্কা, বয়া ও বাতি স্থাপন ৯. মাস্টার/ড্রাইভার পরীক্ষা, সনদ বিতরণ ও সনদ নবায়ন, বেআইনি নৌ চলাচল বন্ধ করা ১০. নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সব ধরনের অনিয়ম ও শ্রমিক হয়রানি বন্ধ করা এবং ১১. নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

নৌ শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মধ্যেও শনিবার ঢাকা সদরঘাট থেকে কিছু লঞ্চ ছেড়ে যায়।

ঢাকায় আমাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চাঁদপুর

নৌ ধর্মঘটের মধ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কয়েকটি লঞ্চ ভিড়লেও চাঁদপুর থেকে অধিবাংশ রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় সমস্যা পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।

শনিবার দুপুর পর্যন্ত ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা পাঁচটি এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা একটি লঞ্চ চাঁদপুর  নৌবন্দরে পৌঁছেছে। লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের বেশ ভিড় দেখা গেছে এ সময়।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি হারুন আল রশিদ জানান, “কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী চাঁদপুর থেকে সব রুটে নৌ-যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।”

আবুল বাশার নামের এক যাত্রী বলেন, “ধর্মঘটের বিষয়টি জানতাম না। আমি এখন সমস্যায় পড়েছি।”

মোমেনা বেগম নামে আরেক যাত্রী বলেন, চিকিৎসার জন্য তার ঢাকায় যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু লঞ্চ বন্ধ থাকায় এখন সড়কপথেই যেতে হবে।

চাঁদপুর নৌ থানা পুলিশের ওসি মো. আবু তাহের জানান, “নৌ ধর্মঘটে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখানো কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।”

বরিশাল

১১ দফা দাবিতে নৌ শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বরিশালের যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

সকালে ঘাটে গিয়ে লঞ্চ না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। কাছের দূরত্বের কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে ট্রলারে চড়লেও গুণতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া।

বিআইডব্লিউটিএ-এর বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু বলেন, “শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে যে লঞ্চগুলো ছেড়ে এসেছে সেগুলো ভোর রাতে বরিশাল লঞ্চঘাটে পৌঁছেছে। কিন্তু শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে আজ ভোর থেকে কোনো লঞ্চ ঘাট ত্যাগ করেনি।”

ভোলার বাসিন্দা রবিউল আউয়াল জানান, চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার বরিশালে এসেছিলেন তিনি। শনিবার ভোরে লঞ্চঘাটে গিয়ে শোনেন শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছে। এখন কীভাবে বাড়ি ফিরবেন সেই চিন্তায় আছেন তিনি।

একই অবস্থা মেহেন্দিগঞ্জের আশ্রাফুর রহমানের। সকালে ঢাকা থেকে এসে বরিশাল নামার পর মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার পাতারহাটে যাওয়ার জন্য লঞ্চ পাননি তিনি। ফলে ঝুঁকি নিয়েই ট্রালারে চেপে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বরিশাল শাখার যুগ্ম সম্পাদক একিন আলি মাস্টার বলেন, এর আগেও তারা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। মন্ত্রনালয় থেকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস পেয়ে কাজে ফিরেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তাদের দাবি পূরন হয়নি। তাই এবার দাবি না মানা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।

মোংলা বন্দর অচল

এগারো দফা দাবিতে নৌ শ্রমিকদের ধর্মঘটে মোংলা বন্দরে জাহাজ থেকে পন্য ওঠানামার কাজ কার্যত বন্ধ রয়েছে। শনিবার সকালে কোনো পণ্যবাহী বার্জ, কার্গো, কোস্টার বা ট্যাংঙ্কারও মোংলা ছেড়ে যায়নি।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার ফখর উদ্দীন আহমেদ বলেন, ইউরিয়া সার, গ্যাস, গাড়ি ও ক্লিংকারবাহী মোট ২৬টি জাহাজ বন্দরে অবস্থান করছে।

নৌ শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মধ্যে শনিবার ঢাকা সদরঘাটের চিত্র।

“নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের মধ্যে জেটিতে অবস্থান করা মাত্র চারটি জাহাজে পণ্য ওঠামার অল্প কিছু কাজ চলছে। জেটির বাইরে থাকা জাহাজে কোনো কাজ হচ্ছে না। ধর্মঘট বেশি সময় চললে বন্দরে পণ্যজট সৃষ্টি হবে। জাহাজে পণ্য খালাস কাজ ব্যাহত হবে। আমদানিকারদেরও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।”

বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের মোংলা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, “দেশে নৌপথে অন্তত ২০ হাজার নৌযান  (কোস্টার, কার্গো ও ট্যাংকার)  পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করে। দুই লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করে এই খাতে। গত দশ বছরে নদীপথে অসংখ্য ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। নৌযান শ্রমিকরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় থাকে।  আমাদের ১১ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।”

দাবি আদায়ে শনিবার সকালে খুলনার ঘাট এলাকায় শ্রমিকরা মিছিল করেছেন বলে জানান বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন।

নারায়ণগঞ্জ

বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশন ও বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ধর্মঘটে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর থেকে অধিকাংশ গন্তব্যের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে।  

সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটের অল্প কিছু লঞ্চ ছেড়ে গেলেও দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। সেই সঙ্গে কার্গো জাহাজ, ট্যাংকার ও বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল বন্ধ থাকায় পণ্য পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে।

দাবি আদায়ে শনিবার সকাল থেকেই শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন নৌ-যান শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের ১১ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে নৌ-যান শ্রমিক ও কর্মচারীদের খোরাকি ভাতা ফ্রিসহ ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ, মাস্টার ড্রাইভারশিপ পরীক্ষায় ও ডিপিডিসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সকল প্রকার অনিয়ম বন্ধ, কোর্স চলাকালে শ্রমিকদের ছুটি বাধ্যতামূলক করা, নৌ-যান শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য পৃথক চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, নৌ-পথে ‘মোবাইল কোর্টের নামে’ হয়রানিসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নৌ-শ্রমিকের মৃত্যু হলে ১২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস সার্ভিস ভিসার ব্যবস্থা করা।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদার বলেন, “দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই আন্দোলন চলবে।”

ঢাকা সদরঘাটে লঞ্চ চলছে জোড়াতালি দিয়ে

দক্ষিণের জেলাগুলোতে নৌ শ্রমিকদের ধর্মঘট পুরোমাত্রায় চললেও সকালে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে বেশ কিছু লঞ্চ।

বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক হুমায়ুন কবির জানান, শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত মোট ২০টি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার মধ্যে আটটি বাদে সবই ছেড়ে গেছে।

অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও যাত্রী পরিবহন সংস্থার সদস্য হাম জালাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নৌযান শ্রমিকদের মূল দাবিগুলো মেনে নিয়ে লঞ্চ মালিকপক্ষ ২০১৬ সালে নৌযান শ্রমিকদের সঙ্গে পাঁচ বছরের একটি চুক্তি করেছিল। সে চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হবে। তাই তাদের ধর্মঘটে যাওয়া ‘অযৌক্তিক’।

“মাস্টার ড্রাইভার আর সুকানিরা আসায় আমরা সকালে লঞ্চ ছাড়তে পেরেছি। বিকালে কী হবে জানি না। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি তারা এভাবে ধর্মঘট করতে পারে না।”

তবে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম দাবি করেন, মাস্টার ড্রাইভার আর সুকানিরা ধর্মঘটে থাকায় মালিকপক্ষ অন্য কর্মচারীদের দিয়ে ‘জোর করে’ লঞ্চ চালাচ্ছে।

“আমরা ধর্মঘটে আছি। আমরা তো জোর করে থামিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু মালিকরা জোর করে লঞ্চ চালাচ্ছে।”

লঞ্চ আসলে কারা চালাচ্ছে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক হুমায়ুন কবির বলেন, “অন্যদিন যে মাস্টার ড্রাইভাররা লঞ্চ ছাড়ার অনুমতি নেয়, আজ তারাই অনুমতি নিয়েছে। যথাযথ লোক থাকলে তবেই আমরা লঞ্চ ছাড়ার অনুমতি দিই।”