হাসিনা-মোদীর যৌথ বিবৃতিতে আসেনি এনআরসি

নয়া দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বহুল আলোচিত আসামের নাগরিকপঞ্জির প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি, যা নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ রয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2019, 03:20 PM
Updated : 5 Oct 2019, 05:11 PM

এই আলোচনায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়েও সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি মেলেনি। অন্যদিকে ফেনী নদীর পানি ভারতের ত্রিপুরায় সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চুক্তি হয়েছে।

নরেন্দ্র মোদী আবারও বলেছেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে ভারতের সব অংশীদারের সঙ্গে কাজ করছে তার সরকার।

রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়েও একমত হয়েছেন প্রতিবেশী দুই দেশের নেতারা।

গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাওয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিস্তা ও আসামের নাগরিকপঞ্জিসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয় তুলবেন তারা।

নয়া দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে শনিবার বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিআইডি

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, শনিবারের বৈঠকে উভয় নেতা দুই দেশের ‘অসাধারণ’ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন। ঐতিহাসিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দুই দেশের সার্বভৌমত্ব, সমতা, আস্থা ও বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে সব ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে, যা ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপকে’ ছাড়িয়ে গেছে।

দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করেছেন এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করেছেন বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

যে কোনো ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক অংশীদারিত্ব এগিয়ে নেওয়ার সুযোগকে পুরোদমে কাজে লাগানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন তারা।

দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকেই বাংলাদেশ-ভারত সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন তিনটি যৌথ প্রকল্প।

>> স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত; ওই পানি তারা ত্রিপুরা সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে।

>> উপকূলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থার (কোস্টাল সারভেইল্যান্স সিস্টেম-সিএসএস) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ।

>> চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের বিষয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়েছে।

>> চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে।

>> সহযোগিতা বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব হায়দরাবাদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

>> এছাড়া সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিনিময় নবায়ন এবং যুব উন্নয়নে সহযোগিতা নিয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

নয়া দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। ছবি: পিআইডি

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে দুই সরকারের সম্মতি অনুযায়ী তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে ফ্রেমওয়ার্ক অব ইন্টেরিম এগ্রিমেন্ট আশু স্বাক্ষর ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশের মানুষের অপেক্ষার কথা তুলে ধরেন।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে এই চুক্তি নিয়ে সমাধানের জন্য ভারতের সব অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে’ তার সরকার।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে চুক্তি আটকে যাওয়ার পর থেকেই এই কথা বলে আসছে নয়া দিল্লি।

এদিকে সম্প্রতি ভারতের আসাম সরকার প্রকাশিত এনআরসির (নাগরিকপঞ্জি) চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়াদের (১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন) বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।  

গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা সফরে এসে বলেছিলেন, এটা তাদের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং কোনোভাবে বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না।

তবে তারপরে আসামের অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে ১৪-১৫ লাখ ‘অবৈধ অভিবাসীকে’ বাংলাদেশে ফেরত নিতে বলার পরিকল্পনার কথা জানালে বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়। এরপরে অবশ্য নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন বলে তার মুখপাত্র জানান।

গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এবং আসামে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর এটাই তার প্রথম নয়া দিল্লি সফর।

আলোচনায় রোহিঙ্গা

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

রোহিঙ্গাদের জন্য ভারতের মানবিক ত্রাণ সহায়তার পঞ্চম চালান পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

এই চালানে তাঁবু ও উদ্ধার কার্যক্রমের সরঞ্জামের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে এক হাজার সেলাই মেশিন পাঠানো হবে।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রথম প্রকল্পে আড়াইশ বাড়ি নির্মাণ কাজ শেষ করেছে ভারত। এখন তারা ওই এলাকায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের আরেক গুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় সহায়তার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উভয় নেতা বাস্তুচ্যুত এই ব্যক্তিদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজ ভূমিতে নিরাপদে, দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাসন ত্বরাণ্বিতের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত হন।

এজন্য মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়েও তারা একমত প্রকাশ করেছেন।