ঈদযাত্রায় সেই যানজটের ভোগান্তি

মহাসড়কে যানজটে দুই-আড়াই ঘণ্টার পথ যেতে লাগছে সাত থেকে আট ঘণ্টা, অপরদিকে টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিলম্বিত হচ্ছে রেল যাত্রা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও জেলা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2019, 08:29 PM
Updated : 9 August 2019, 09:40 PM

রেল স্টেশনে দীর্ঘ অপেক্ষা আর মহাসড়কে ধুঁকতে ধুঁকতে এগোনোর মধ্য দিয়ে শুক্রবার ঘরের পথ ধরেছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের যাত্রীরা।

শুক্রবার বেলা ১টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ে সেতুতে উঠার আগে লাইনচ্যুত হয় ঢাকা থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের একটি বগির দুটি চাকা।

এই দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও এই পথ দিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশে লাইনচ্যুত হয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা রেল চলাচল বন্ধ থাকে, এতে এলোমেলো হয়ে গেছে ট্রেনের সূচি

পরে উদ্ধারকারী ট্রেন গিয়ে বগিটি লাইনে তোলার পর বিকাল পৌনে ৫টার দিকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপাড় রেল স্টেশন মাস্টার মাসুম আলী খান জানান।

এবার ঈদযাত্রার শুরু থেকেই পশ্চিম রেলের অর্থাৎ রাজশাহী ও রংপুরগামী ট্রেনগুলো দেরিতে ছাড়ছিল। যে ট্রেনটি টাঙ্গাইলে লাইনচ্যুত হয়েছে, সেই সুন্দরবন এক্সপ্রেসের সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি ২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট দেরিতে কমলাপুর ছাড়ে।

এরপরে ওই দুর্ঘটনার কারণে এই রুটের সব ট্রেনের সূচিই এলোমেলো হয়ে পড়ে, ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হয় আরও কয়েক ঘণ্টা।

এদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সারা দিনই ছিল যানজটের ভোগান্তি। গাবতলী থেকে আরিচা যেতে সাত থেকে আট ঘণ্টা লেগে যায় বলে জানিয়েছেন অনেকে।

যানজটের ধকল পোহাতে হয়েছে সড়ক পথে উত্তরবঙ্গের যাত্রীদেরও। ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় পৌঁছাতেই সাত-আট ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। মধ্যরাতেও ওই পথে যানজট দেখা যায়।

তবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেটের পথে যানজটের তেমন খবর পাওয়া যায়নি। গত ঈদের আগে দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু চালু হওয়ার পর এই পথে যানজটের ভোগান্তি কমার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঈদযাত্রায় ভোগান্তির কথা স্বীকার করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, সড়ক-মহাসড়কে কোনো সমস্যা নেই।

দুপুরে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, “এবারকার ঈদ যাত্রায় সড়ক- মহাসড়কে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ফেরি ঘটে। সমস্যা হচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে, নদীতে প্রচণ্ড স্রোত, মাওয়া থেকে জাজিরা প্রান্তেও প্রচণ্ড স্রোত। সেখানে মাঝে মাঝে ফেরি বন্ধ হয়ে যায়।

“নদীর স্রোতের কারণে ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, যার কারণে গাড়ি আসতে পারছে না।”

 মন্ত্রী সড়ক-মহাসড়কে সমস্যা নেই বলে দাবি করলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। মহাসড়কে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যানজটে যাত্রীদের ভোগান্তির কথা। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারা।

স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসের ছাদে করে বাড়ির পথে মানুষ। ঢাকার আমিনবাজার এলাকা থেকে তোলা ছবি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সন্ধ্যায় পাটুরিয়া ঘাটে পদ্মা পারের অপেক্ষায় থাকা সোহাগ পরিবহনের যাত্রী মতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাটে আসতে আমার গাড়ির সময় লেগেছে সাত ঘণ্টা।”

গাড়ির চালক বিল্লাল হোসেন যাত্রীর কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, “সাভার, নবীনগর, ধামরাই, মানিকগঞ্জের বানিয়াজুরী, মহাদেবপুর, বরংগাইল আর উথলী হয়ে পাটুরিয়া ঘাটে আসতে সাত ঘণ্টা সময় লেগেছে। স্বাভাবিক সময়ে লাগে আড়াই ঘণ্টার মতো।”

ব্যক্তিগত বিভিন্ন গাড়িরও চাপ পড়েছে পাটুরিয়া ঘাট এলাকায়। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, জিপ পাটুরিয়ার পাঁচ নম্বর ঘাট থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপড়া পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দীর্ঘ সারিতে আটকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে সন্ধ্যা ৭টায়। তবে সন্ধ্যার পর থেকে চাপ কমতে শুরু করে।

চৌধুরী মহিবুল ইসলাম নামে একজন বলেন, তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা থেকে পাটুরিয়া ঘাটে এসেছেন আট ঘণ্টায়।

সড়কে ‘সৃশংখলা না থাকায়’ এবার যাত্রীদের ভোগান্তি হচ্ছে বলে অভিমত তার।

রাত ৮টায় মহাসড়কের নয়াডিঙ্গি থেকে টেপড়া পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় যানজট দেখা যায়।

মানিকগঞ্জের এই যানজট ছিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের প্রায় পুরোটায়

সরেজমিনে দেখা গেছে, শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত যানবাহনে চাপ ও সুশৃংখলাভাবে না চলার কারণে ধীরগতিতে চলে যানবাহন। মাঝেমধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই স্থানেই আটকে থাকে যানবাহনগুলো। বেলা ২টার পর থেকে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

বরংগাইল হাইওয়ে পুলিশের ওসি ইয়ামিন-ই-দৌলা যানবাহনের ধীরগতির কারণ হিসেবে বলেন, “যে পরিমাণ গাড়ি এই সড়ক দিয়ে চলাচল করত, তার চেয়ে অনেক বেশি চলছে ঈদ উপলক্ষে। এ কারণে এ অবস্থা হয়েছে।

“এছাড়া ঈদ উপলক্ষে অসংখ্য পুরনো গাড়ি এসছে। সেগুলো রাস্তার মধ্যে বিকল হয়ে পড়ায় যানজট দেখা দিচ্ছে।”

আর মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার রিফাত রহমান শামীম বলেন, “পাটুরিয়া ঘাটে কোনো ভোগান্তি নেই। মহাসড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে কিছুটা দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।”

পাটুরিয়া লঞ্চ ঘাটে দুপুরের পর থেকে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়। যাত্রীর চাপ সামলাতে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়। এই সুযোগে নির্ধারিত যাত্রীদের চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ছেড়ে যেতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ নৌপরিবহন সংস্থার আরিচা কার্যালয়ে ডিজিএম মো. আজমল হোসেন বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পথে ফেরির সংখ্যা বাড়িয়ে ২০টা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ফেরি থাকায় যানবাহন ও যাত্রী পারাপারে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খানা-খন্দ আর বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জে ওই এলাকার গাড়ির চাপ বেশি থাকায় যানজট দেখা দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মোহাম্মদ আহাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জ অংশে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপের কারণে গাড়ি টানতে পারছে না চালকরা।

“এ কারণে শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত অন্তত তিনবার বন্ধ থাকে সেতুর টোল আদায়। ফলে টাঙ্গাইল অংশে জট লাগে।”

এই জট বিকালেও কিছুটা থাকলেও তারপর ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে গাড়িগুলো। মধ্যরাত ১২টার পরেও কোনো জায়গায় যানজট এবং ধীরে ধীরে চলতে দেখা যায় সব গাড়ি।

বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায় বন্ধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে সেতুতে কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল বলেন, “সেতুর পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জ অংশ থেকে উত্তরবঙ্গমুখী যানবাহন চলতে না পরায় সেতু দিয়ে যান চলাচল মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এতে সেতু কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।”

সড়কে উত্তরাঞ্চলের যাত্রীদের ধুঁকতে হচ্ছে সিরাজগঞ্জের পরেও

সরেজমিনে দেখা গেছে, সেতুর পূর্বপাড় থেকে টাঙ্গাইলে করোটিয়া পর্যন্ত অন্তত ৩০ কিলোমিটারজুড়ে দিনব্যাপী থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়। খুবই ধীরগতিতে যান চলাচল করে এখানে।

টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় দায়িত্বরত জেলা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক সাজেদুল ইসলাম বলেন, “এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় খান-খন্দ হওয়ায় এ এলাকায় গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে। যানবাহন থেমে থেমে চলছে।”

ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত যান ও পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা বেশি বলে জট লাগার কথা জানিয়েছেন সেতুর পূর্বপাড়ে দায়িত্বরত জেলা পুলিশের ট্রাফিক পরিদর্শক ইফতেখার নাসির রোকন।

ঢাকা থেমে দিনাজপুরগামী মাহমুদুর রহমান বলেন, “আমি ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে রওনা হয়ে দুপুর ১টায় প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টায় এলেঙ্গা পৌঁছেছি। বাড়ি যেতে আর কতক্ষণ লাগবে জানি না।”

এক নারী নিজেকে একাত্তর টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ফারহানা রহমান পরিচয় দিয়ে বলেন, ঈদের ছুটিতে তিনি স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাচ্ছেন।

“সকাল ৬টায় ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করি। রাস্তায় যানজটের কারণে বিকেল সাড়ে ৪টায় টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এলেঙ্গা রিসোর্ট এলাকায় পৌঁছাই। জীবনে এত লম্বা সময় যানজটে আটকা পড়ে রাস্তায় এর আগে কখনও বসে থাকিনি।”

‘অত্যন্ত কষ্টে’ চলাচল করছেন বলে জানান একাধিক যানের চালক।

গোড়াই হাইওয়ে থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম বলেন, “করটিয়া থেকে ধেরুয়া পর্যন্ত প্রায় ৩৬ কিলোমিটার আমাদের কার্যপথ। এখানে ঢাকামুখী যানগুলো ধীরগতিতে চলছে। আর টাঙ্গাইলগামী পথে কোনো যানজট নেই।”

মহাসড়কে যানজট নিরসনে ও নিরাপত্তার জন্য জেলা পুলিশের সাত শতাধিক সদস্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আহাদুজ্জামান মিয়া।