ঢাকার জজ আদালতে যে এলিভেটর ছিঁড়ে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীসহ ১২ জন আহত হয়েছেন, তার মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছিল বহু আগেই।
Published : 07 Mar 2019, 06:10 PM
১৯৮০ সালে তৈরি ওই এলিভেটর এর আগেও কয়েকবার বন্ধ হয়ে ভেতরে লোক আটকা পড়ার ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে আইনজীবীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এবার এরকম দুর্ঘটনা ঘটল।
জেলা জজ আদালত কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদনে জমা দিতে বলেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জজ আদালতের পুরনো ভবনের ওই এলিভেটরের কেবল ছিঁড়ে যায়। ১২ জন আরোহী নিয়ে বিকট শব্দে পাঁচ তলা থেকে নিচে পড়ে এলিভেটরটি।
দিনের শুরুতে ওই সময়টায় আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় ছিল এমনিতেই বেশি। ঢাকা আইনজীবী সমিতির স্থগিত হওয়া নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনের ভোট চলছিল বলে আইনজীবীদের আনাগোনাও বেশি ছিল।
দুর্ঘটনার পরপরই আহতদের বের করে প্রথমে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে এলিভেটরের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখেন বলে সদর দপ্তরের পরিদর্শক রাউহুজ্জামান জানান।
ওই সময় এলিভেটরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আইনজীবী জানান, দুর্ঘটনার পর ভেতরে আটকে পড়া আরোহীরা আতঙ্কে চিৎকার শুরু করেন। পরে দুমড়ে যাওয়া এলিভেটরের ভেতরে রক্তের দাগও দেখা যায়।
সরকারের পূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের বরাত দিয়ে কোতোয়ালি পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি ওই এলিভেটর তৈরি করেছিল ১৯৮০ সালে।
“সাধারণভাবে একটি এলিভেটরের মেয়াদ থাকে ২০ থেকে ২৫ বছর। এই এলিভেটরের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।”
ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৮ জন হলেও ভিড়ের কারণে নিয়মিতভাবে ওই এলিভেটর দিয়ে বেশি লোক ওঠানামা করত। দুর্ঘটনার সময় সেখানে ১২ জন ছিলেন।
“ওভারলোড হলে আধুনিক এলিভেটর যেমন সংকেত দিয়ে দরজা খুলে দেয়, তেমন কোনো ব্যবস্থা এখানে ছিল না। বিপদ সংকেতের কোনো বাতিও এই এলিভেটরে নেই।”
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ওই এলিভেটর দিয়ে পুরনো আদালত ভবনে ওঠানামা করত জানিয়ে জজ আদালতের আইনজীবী স্বরাজ চ্যাটার্জি বাপ্পা বলেন, “লিফটটা অনেক পুরনো, জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। আইনজীবী সমিতি আর পিডব্লিউডির প্রকৌশলীদের বহুবার বলা হয়েছে, কিন্তু তারা কানে তোলেনি।”
কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মওদুত হালদার বলেন, আহত ১২ জনের মধ্যে আটজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং তিনজনকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়েছে। আরও একজন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আটজন হলেন আইনজীবী সুলতান আহমেদ, আইয়ুব আলী, সোহাগ ও মিঠু, লিফটম্যান জাহাঙ্গীর আলম, আদালতের পেশকার সুমন, মুহুরি আমিন ও আসামি সুজন।
পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন অ্যাডভোকেট শামসুন্নাহার, অফিস সহকারী জহিরুল ও সাক্ষী আঞ্জুমান আরা।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোটগ্রহণের মধ্যে এলিভেটর ছিঁড়ে পড়ার এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে আইনজীবীদের অনেকের কাছ থেকে।
নুরুজ্জামান তপন, দুলাল মিত্রসহ জজ আদালতের বেশ কয়েকজন আইনজীবী বলেছেন, জেলা জজ আদালত কর্তৃপক্ষ, ঢাকা আইনজীবী সমিতি আর পিডব্লিউডি- সবারই দায় রয়েছে এ ঘটনায়।
একাধিক আইনজীবী ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, সমিতির নেতাদের বেশিরভাগই সাধারণ আইনজীবীদের স্বার্থ দেখেন না, তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারেই ব্যস্ত থাকেন।
অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির বিদায়ী সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান এলিভেটর ছিঁড়ে পড়ার ওই ঘটনাকে বিচারক, বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের ‘ভাগ্যের দোষ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, “এই লিফট আগেও ছিঁড়ে পড়েছে, কয়েকবার নষ্ট হয়েছে। তখনও ভেতরে আইনজীবীরা আটকা পড়েছেন। আগে কেউ আহত হননি। কিন্তু আজ হয়েছেন।”
গোলাম মোস্তফা বলেন, “চল্লিশ বছর ধরে আমরা এই লিফট ব্যবহার করছি। সব কিছু স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে, চকচকে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পুরাতন আদালত ভবনে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, এমনকি বিচারকদেরও এই লিফট ব্যবহার করতে হত। এটা কার দায়, কীসের দায়…।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জেলা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি ২৭ মাস ঢাকার বাইরের আদালতে দায়িত্ব পালন করে সম্প্রতি ঢাকার আদালতে যোগ দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চান না।
“পিডব্লিউডির একটা দায় অবশ্যই আছে। কিন্তু আমি শুনেছি, লিফটে লোকও বেশি উঠেছিল। তদন্ত কমিটিই বলবে এখানে কার দায় আছে।”
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রদীপ কুমার রায়কে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে কর্তৃপক্ষ।
এলিভেটর ছিঁড়ে পড়ার ঘটনায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।
আহতদের দেখতে হাসপাতালে আইনমন্ত্রী
এলিভেটর দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে তাদের চিকিৎসার জন্য ‘প্রয়োজনীয় সবকিছু’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আইন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মন্ত্রী কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কাছে আহতদের খোঁজ-খবর নেন এবং তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।
গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসে আইনমন্ত্রী ঢাকা জজ কোর্টে পাঁচটি এলিভেটর বসানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর এক কোটি ৮৬ লাখ ৮৮ হাজার ৬৩২ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে এলিভেটর স্থাপনের ওই কাজ চলছে।