পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা-গুদাম সরবে কবে

নয় বছর আগে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঢাকার রাসায়নিকের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়া।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2019, 01:59 PM
Updated : 10 March 2019, 02:18 PM

২০১০ সালের ১৫ জুন ওই কমিটির প্রতিবেদনে যে ১৭টি সুপারিশ করা হয়েছিল কিছু কিছু বাস্তবায়ন হলেও আসল কাজটিই করা সম্ভব হয়নি গত নয় বছরে।

পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামগুলো সরানোর দায়িত্বে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০১৭ সালের মার্চে একবার অভিযান শুরু করলেও কয়েকদিনের মাথায় তা থেমে যায়।

মেয়র সাঈদ খোকনের দাবি, এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠন এফবিসিসিআইর অনুরোধে তারা অভিযান এগিয়ে নিতে পারেননি।

“আমরা একটা ম্যাসিভ ড্রাইভ দিলাম। অনেকগুলো কারখানা বন্ধ করলাম, মামলা করলাম, সিলগালা করলাম। তখন এফবিসিসিআই এবং শিল্পমন্ত্রী আমাকে বলেন, বিসিক শিল্প নগরী হলে এগুলো উঠিয়ে দিতে। আমাকে অনুরোধ করলে তাদেরকে কিছুটা সময় দিয়ে স্থানান্তর করতে। তখন এ প্রক্রিয়াটা থেমে গেল। নইলে ওই সময়েই একটা ধাক্কা দিয়ে দিতাম।”

তবে এ বছর আবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছেন জানিয়ে সাঈদ খোকন বলেন, “গত সোমবারও মোবাইল কোর্ট করেছি। এর আগে এফবিসিসিআই এবং কেমিক্যাল কারখানার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে আমরা বলেছি ২৯টা দাহ্য পদার্থ স্টক করা যাবে না। স্যাম্পল কিছু রাখতে পারবে। তাদের গোডাউন কেরানীগঞ্জে নিয়ে যাবে। এখানে তারা ট্রানজেকশন করবে। ডেলিভারি দেবে সেখান থেকে। এরমধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেল।”

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের রাসায়নকি ও দাহ্য পণ্যের চিহ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের কারণেই ভয়াবহ মাত্রা পায় আগুন

পুরান ঢাকার মানুষের মানসিকতাও একটা বড় বাধা বলে দাবি করেন মেয়র।

“পুরান ঢাকার মানুষ গোডাউন বা কারখানাগুলো সরাতে চায় না। কারণ একটা ফ্ল্যাট যে পরিমাণ ভাড়া দেয় একটা গোডাউন ভাড়া দিলে ডবল-ট্রিপল পেমেন্ট পায়। বেশি টাকা-পয়সার লোভে অনেকেই গোডাউন ভাড়া দিয়ে দেয়। হাজার হাজার বাড়িঘর, ছোট্ট একটা ঘরের ভেতরে গোডাউন, এটা খুঁজে বের করাও কঠিন। এ কারণেও এটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”

তদন্ত কমিটির সুপারিশের পর ২০১০ সালে রাজধানীর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা’ প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায় আট বছর পর গত বছরের ৩০ অক্টোবর।

২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। বিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ৩ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এই কাজে ধরিগতির জন্যও শিল্প মন্ত্রণালয়কে দূষছেন মেয়র সাঈদ খোকন।

তিনি বলেন, “শিল্প মন্ত্রণালয় কেমিক্যাল পল্লী করার দায়িত্ব নিলেও তারা খুব ধীরে তা করছে। ২০১০ সালে যখন নিমতলী ট্র্যাজেডি হয় তখনই এই পল্লী হয়ে যাওয়ার কথা। ওদেরকে আমরা তাগিদ দিয়েছি তাড়াতাড়ি করার জন্য। তবে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা থাকায় তারা এগোতে পারেনি। তারা এর কাজ এখন মাত্র শুরু করেছে।”

অন্যদিকে বিসিক কর্মকর্তারা বিলম্বের জন্য রাসায়নিকের ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতাকে দায়ী করেছেন।

নিমতলী ঘটনার পর আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ২০১১ সালে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জমি চিহ্নিত করে সেখানে ১৭তলা করে কয়েকটি ভবন তৈরি করে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামের জন্য বরাদ্দ দিতে ডিপিপিও করা হয়েছিল।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের রাসায়নকি ও দাহ্য পণ্যের চিহ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের কারণেই ভয়াবহ মাত্রা পায় আগুন

কিন্তু এ ব্যাপারে রাসায়নিক কারখানা মালিকদের তিনটি সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য একাধিকবার বসলেও তারা সে সময় কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি বলে জানিয়েছেন বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) খোন্দকার আমিনুজ্জামান।

তিনি বলেন, “সভা ডাকলেও সেসব সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাতে উপস্থিত থাকতেন না। তারা এমওইউ স্বাক্ষর করেনি, টালবাহানা করেছে। তাদের কাছ থেকে আমরা যথাসময়ে সহায়তা পাইনি।

“এক সমিতি আসে তো দুই সমিতি আসে না। তিন সমিতিকে একত্রে পাওয়াও যায় না। পরে অনেক অনুরোধ করে তাদেরকে আনতে পেরেছি। শেষে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটা সভায় তারা জানায়, ভবন করলে তারা যাবেন না, প্লট করলে যাবেন।”

পরে আবার নতুন করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হয়েছে বলে জানান খোন্দকার আমিনুজ্জামান।

বর্তমানে কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ ব্রাহ্মণকীর্ত্তা মৌজায় ৫০ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে ৯৩৬টি প্লট করা হবে বলেও জানান তিনি।

প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিসিকের চেয়ারম্যান মো. মোশতাক হাসান বলেন, “এটা আমাদের নম্বর ওয়ান প্রায়োরিটি। আমাদের প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেছে। এখন আমরা জমি অধিগ্রহণে যাব।”

তবে জমি অধিগ্রহণেই বেশি সমস্যা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অধিগ্রহণ হয়ে গেলে অন্য সব কাজ শেষ করতে দুই বছরের বেশি সময় লাগবে না।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের রাসায়নকি ও দাহ্য পণ্যের চিহ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের কারণেই ভয়াবহ মাত্রা পায় আগুন

‘এত বড় ঘটনা এড়ানো যেত’

২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব মো. ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ওই বছরের ১৫ জুন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সে প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ড রোধে ১৭টি সুপারিশ করা হয়।

সুপারিশে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, পুরান ঢাকাসহ আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের কোনো গুদাম বা দোকান না রাখা। এছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভবন নির্মাণ এবং অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছিল।

রাসায়নিক ও এসিড জাতীয় দাহ্য পদার্থের দোকান ও বিক্রির সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আরো সতর্ক থাকা, প্রয়োজনে এসব দাহ্য পদার্থ বিক্রি ও রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা শিল্প এলাকা স্থাপন এবং অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে পুরান ঢাকায় ওয়াসার লাইনে দমকল বাহিনীর জন্য ‘হাইড্রেন্ট পয়েন্ট’ রাখার কথাও সুপারিশে ছিল।

তবে সেসবের সুপারিশের সবগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থানে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের রাসায়নকি ও দাহ্য পণ্যের চিহ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবের কারণেই ভয়াবহ মাত্রা পায় আগুন

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সুপারিশগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি, পার্সিয়ালি হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে তো এগুলো (অগ্নিকাণ্ড) হতই না।

“কেউ কেউ শিফট করেছে। কিন্তু এখনও অনেক জায়গায় ওয়্যারাহাউজ করে এগুলো (দাহ্য পদার্থ) রাখা হচ্ছে। সবগুলো সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নিশ্চয়ই এরকম বড় কিছু হত না।”

উচ্চমাত্রার রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কারণেই বুধবার রাতে চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড বিভৎস রূপ নেয় বলে মনে করেন বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. সামসুল আলম।

তিনি বলেন, “যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে প্লাস্টিক দানা রাখা ছিল। এছাড়া পারফিউম, স্প্রে, মশার স্প্রে ডেঞ্জারাস গুডস হিসেবে চিহ্নিত। এগুলো যেহেতু দাহ্য পদার্থ, এতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।এসব জিনিস যদি ওখানে না থাকত তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হত।”

“নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন হলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটত না, আমরা সেটা বলতে পারি,” বলেন এই বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ।