ভিকারুননিসায় ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের সব শাখার ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2018, 07:31 AM
Updated : 5 Dec 2018, 04:50 PM

বুধবার অধ্যক্ষের পক্ষে শিক্ষক মুশতারি সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

“প্রথম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত সকল শ্রেণির ক্লাস-পরীক্ষা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। এটা সব শাখার জন্য সিদ্ধান্ত। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে শিক্ষার্থীদের এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেব।”

সোমবার অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার পর মঙ্গলবার থেকে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা, তাদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকরাও।

তারা নবম শ্রেণির মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত রাখার দাবি জানালেও স্কুল কর্তৃপক্ষ না নিয়ে নেয়। এরপর বুধবার থেকে পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

স্কুল কর্তৃপক্ষ তা না মেনে বুধবারও সব পরীক্ষা নেয়। এরপর দুপুরের দিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত আসে।

গভর্নিং বডির সবার পদত্যাগের যে দাবি শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে পর্ষদের শিক্ষক প্রতিনিধি মুশতারি বলেন, “শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে কারও বিরুদ্ধে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পরবর্তী যে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে যে কোনো সময় গভর্নিং বডি বসতে পারে।”

সামনে জাতীয় নির্বাচন, এই অবস্থায় পরীক্ষা কীভাবে শেষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অতীতেও আমরা বিভিন্ন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সময় শুক্রবারে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়েছি। এবারও সেরকম হতে পারে।”

 

মেয়েরা হয়ত প্রস্তুতি নিতে পারেনি- পরীক্ষা পেছানোর জন্য এটিও একটি কারণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শিক্ষার্থী-অভিভাকদের বিক্ষোভের মধ্যে বুধবার প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্ত এবং তাদের এমপিও বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ও র‌্যাবকে নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বুধবার আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রধান ফটকের সামনে দাবি আদায়ের পক্ষে স্লোগান দাবি উত্থাপন করা হলেও আরেকটি পক্ষ ভেতরে অবস্থান নেয়।

ওই সময় শিক্ষকদের পক্ষে মুশতারি সুলতানা বলেন, “পুরো বিষয় আদালতে চলে গেছে, সিদ্ধান্ত আদালত নেবে।”

গত সোমবার শান্তিনগরে নিজের বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী।স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, আগের দিন রোববার অরিত্রী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিল। অন্যদিকে স্বজনদের দাবি, অরিত্রী নকল করেনি।

সোমবার অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নেওয়া হয় স্কুলে। তখন অরিত্রীর সামনে তার বাবা-মাকে অপমাণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।অরিত্রীর স্বজনরা বলছেন, বাবা-মার ‘অপমান সইতে না পেরে’ ঘরে ফিরে আত্মহত্যা করেন এই কিশোরী।

শিক্ষক মুশতারির সংবাদ সম্মেলনের পর ঘটনার দিন অধ্যক্ষের কার্যালয়ের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও সাংবাদিকদের দেখানো হয়।

সেখানে অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে অরিত্রীকে বের হয়ে যেতে দেখা যায়। তবে তার বাবা-মা দ্বিতীয়বারের মত ফিরে এসে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে যান।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষক জিনাত আখতারের কক্ষেই বেশি অপমানের শিকার হয়েছিলেন অরিত্রীর বাবা-মা। সেখানকার ভিডিও আছে কি-না সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।

অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস শিক্ষার্থী অরিত্রীর অভিভাবকদের অপমান করার কথা ইতোমধ্যে অস্বীকার করেছেন। তবে অধ্যক্ষকে কয়েকবার অনুরোধ জানিয়েও অরিত্রীর বাবা-মায়ের ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি ভিডিওতে স্পষ্ট।

অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বরখাস্ত হওয়া ওই তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগের দিন ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ অভিযোগে মামলা করেছেন তার বাবা।

বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষকরা বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানালেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করে।

অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করার বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের আনষ্ঠানিক ঘোষণাসহ ছয় দফা দাবি তুলে সেসব মেনে না নেওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের পক্ষে আনুশকা রায় সাংবাদিকদের বলে, “আমরা শুনেছি, আমাদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের অধ্যক্ষ বা মুখপাত্রের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চাই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমাদের অবস্থান চলতে থাকব।”

শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি হল- অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসকে বরখাস্ত ও আত্মহত্যার প্ররোচনার কারণে ৩০৫ ধারায় মামলা করে বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া; কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হবে না- এমন নিশ্চয়তা দেওয়া; কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের টিসি দেওয়া বা হুমকি দেওয়া বন্ধ করা; শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার জন্য প্রত্যেক ক্লাসে মনোবিদের ব্যবস্থা রাখা; গভর্নিং বডির প্রত্যেক সদস্যের পদত্যাগ; এবং আন্দোলনকারী কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া।

স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার বিকাল ৫টার দিকে স্কুলের সামনে এসে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিয়ে তাদের আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি লিখিত আকারে তার হাতে তুলে দেয়।

তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা গভর্নিং বডির হাতে পৌঁছানোর কথা এ সময় সাংবাদিকদের জানান গোলাম আশরাফ।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “শিক্ষা মন্ত্রণালয় তিনজনকে বরখাস্ত করার কথা বলেছে। আমরা গভর্নিং বডি সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব।”

গভর্নিং বডির সদস্যদের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে এক প্রশ্নে আলী আশরাফ বলেন, “আগে মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত এসেছে আমরা সেটা বাস্তবায়ন করব। সেটার জন্য বসব আমরা।”

ছয় দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় পুনরায় স্কুলের সামনে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিকালে সাড়ে ৫টার দিকে ঘরে ফিরে শিক্ষার্থীরা।