ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় ঢাকার নামি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
Published : 05 Dec 2018, 11:57 AM
ভিকারুননিসার অধ্যক্ষসহ ৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা
ওই তিন শিক্ষকের এমপিও বাতিলের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করাসহ আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ছাড়া বাকি দুজন হলেন- প্রভাতী শাখার শিফট ইনচার্জ জিনাত আখতার এবং ক্লাস টিচার হাসনা হেনা।
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে যে মামলা করেছেন, তাতেও ওই তিনজনকে আসামি করা হয়েছে।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় টানা দুদিন ধরে বেইলি রোডের স্কুল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল নাহিদ।
তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় ‘প্ররোচনার প্রমাণ’ পেয়েছে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে ভিকারুননিসার সব শাখার ক্লাস ও পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা করেছে বলে বেইলি রোড শাখার শিক্ষক মুশতারি সুলতানা জানিয়েছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল শ্রেণির ক্লাস-পরীক্ষা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।”
গত সোমবার শান্তিনগরে নিজের বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে অরিত্রী। তার আগের দিন পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে তাকে পরীক্ষা হল থেকে বের করে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।
স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অরিত্রী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিল। অন্যদিকে স্বজনদের দাবি, নকল করেনি অরিত্রী।
এরপর সোমবার অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নেওয়া হয় স্কুলে। তখন অরিত্রীর সামনে তার বাবা-মাকে অপমাণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। অরিত্রীর স্বজনরা বলছেন, বাবা-মার ‘অপমান সইতে না পেরে’ ঘরে ফিরে আত্মহত্যা করে ওই কিশোরী।
অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস অভিভাবকদের অপমান করার কথা অস্বীকার করলেও অরিত্রীর আত্মহত্যার খবরে মঙ্গলবার দিনভর বেইলি রোডে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরাও শিক্ষকসহ স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন।
অরিত্রী অধিকারী
অরিত্রীর বাবা-মায়ের আহাজারি
শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রতিবেদন আমরা পর্যালোচনা করেছি। প্রতিবেদনে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই প্রতিষ্ঠানে যে সকল অনিয়ম এবং অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো উঠে এসেছে। অভিভাবকরা নানা ধরনের অভিযোগ করেছেন। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পরে আমি অসংখ্য টেলিফোন পাচ্ছি। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এসে তাদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন।”
অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘খুবই অমানবিক’ হিসেবে বর্ণনা করে নাহিদ বলেন, তদন্ত কমিটি ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার শিফট ইনচার্জ জিনাত আখতার এবং শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছে।
“এখানে (তদন্ত প্রতিবেদনে) বলা হয়েছে- এই তিনজন অরিত্রীর বাবা-মা যখন আবেদন নিয়ে আসলেন, তারা খুবই অসুস্থ, তাদেরকে ভয়ভীতি দেখান, অরিত্রীর পিতা-মাতার সাথে অধ্যক্ষ, শিফট ইনচার্জের নির্মম ও নির্দয় আচারণ অরিত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
“অরিত্রী পিতা-মাতার প্রতি অপমান এবং অসম্মানের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বলেই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। যার দায় কোনভাবেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিফট ইনচার্জ এবং শ্রেণি শিক্ষিকা এড়াতে পারেন না।”
এই পরিস্থিতিতে অরিত্রীর আত্মহত্যায় প্ররোচণাকারী হিসেবে তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে মত দেন শিক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
“এই তিনজনকে আমাদের কমিটির সুপারিশ অনুসারে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, তাদের তিনজনকে বরখাস্ত করা হোক, করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য বিভাগীয় মামলাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এই তিনজন শিক্ষকের এমপিও বাতিল করার জন্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।”
নাহিদ বলেন, তদন্ত কমিটি কেবল ওই ঘটনার জন্য তিনজন দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেনি, আরও বেশ কিছু অনিয়ম ও অসঙ্গতির তথ্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছে।
“ওখানে বহুদিন ধরে অধ্যক্ষ নেই, একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা বার বার তাগিদ দেওয়ার পরও তারা নিয়ম অনুসরণ করে অধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়নি, এটাও একটা বড় ধরনের অনিয়ম।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আপনারা জানেন, আমরা প্রথম যখন দায়িত্ব নিই, আমরা খবর নিয়ে দেখি যে ১০ লাখ টাকা লাগে একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে। সেটা বন্ধ করার জন্য আমরা প্রভাতী সিস্টেম চালু করি ওই স্কুল থেকে।
“কিন্তু দেখা যাচ্ছে যা অনুমতি পায় তার চেয়ে বেশি ভর্তি করে ফেলে। তার মানে অন্য কোনো পথে করে, হয়ে যায়। আমরা শাখা অনুমোদন দিই না, দেখা যাচ্ছে তারা শাখা খুলে বসে আছে। এই তথ্যগুলো কেউ বলে না।”
ভিকারুননিসার যে চেহারা প্রকাশিত হয়েছে তা মানুষের দৃষ্টি খুলে দেবে বলে মন্তব্য করেন নাহিদ।
তিনি বলেন, “থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।… এর আসল চেহরাটা উন্মুক্ত হয়েছে। আমরা এই চেহারাটা খুলে দেব।”
হাই কোর্টের নির্দেশ অনুসারে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে বুধবারই পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হবে বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, সব শিক্ষক এই রকম নয়, ভাল শিক্ষক রয়েছেন। দরদী শিক্ষক রয়েছেন, শিক্ষার্থীকে ভালবাসেন এমন শিক্ষক রয়েছেন। তারা আরও বেশি এগিয়ে আসবেন, অন্য শিক্ষককে প্রভাবিত করবেন।
“ম্যানেজিং কমিটিতে যারা আছেন, তারা শুধুমাত্র খবরদারি করার জন্য নয়, সার্বিকভাবে শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের-শিক্ষকের গুণগত মান উন্নয়ন, মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নে আরো বেশি করে নজর দেবেন।”
“পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, থানাও যোগাযোগ করেছে আমাদের সাথে। আমি আশা করছি তারাও ব্যবস্থা নেবেন। আমাদের ফাইন্ডিংসে তাদের প্ররোচক হিসেবে চিহ্নিত করেছি, এর ফলে পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না।”
নাহিদ বলেন, ম্যানেজিং কমিটি হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তারাও ‘ওই তালিকায়’ পরে যাবে। যদি তারা কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বোঝা যাবে পেছনে তাদেরও প্ররোচনা আছে।
দেশে দুই লাখের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দু’একটা ঘটনা ঘটেই যায়; যখন ঘটে, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
“আমরা নিয়ম করেছি কোনো জায়গায় কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করতে পারবেন না। যারা নির্দেশনা মানছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, চাকরি চলে গেছে।”
এদিকে অধ্যক্ষের বরখাস্তসহ ছয়টি দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা স্কুল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভিকারুননিসার ছাত্রীরা।
শিক্ষার্থীদের পক্ষে আনুশকা রায় দুপুরে স্কুলের সামনে সাংবাদিকদের বলে, “আমরা শুনছি, আমাদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আমরা আমাদের অধ্যক্ষ বা মুখপাত্রের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক ঘোষণা চাই। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমাদের অবস্থান চলতে থাকব।”
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি হল- অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসকে বরখাস্ত ও আত্মহত্যার প্ররোচনার কারণে ৩০৫ ধারায় মামলা করে বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া; কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হবে না- এমন নিশ্চয়তা দেওয়া; কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের টিসি দেওয়া বা হুমকি দেওয়া বন্ধ করা; শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার জন্য প্রত্যেক ক্লাসে মনোবিদের ব্যবস্থা রাখা; গভর্নিং বডির প্রত্যেক সদস্যের পদত্যাগ; এবং আন্দোলনকারী কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া।