নৌকার প্রার্থী ছোট মনিরের বিরুদ্ধে এনআইডি জালিয়াতিরও অভিযোগ

এবার জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে টাঙ্গাইল-২ আসনে যুগ্মভাবে নৌকার প্রার্থী তানভীর হাসান ছোট মনিরের বিরুদ্ধে।

রিয়াজুল বাশারও গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2018, 03:59 PM
Updated : 4 Dec 2018, 04:00 PM

জাতীয় পরিচয়পত্র ‘জালিয়াতির’ পাশাপাশি হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভুয়া তথ্য দেওয়ার অভিযোগ তুলে ছোট মনিরের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি তুলেছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার খন্দকার খাবিরুজ্জামান নামে ওই ব্যক্তি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে এই অভিযোগ পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তার চিঠির একটি অনুলিপি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতেও এসেছে।

খাবিরুজ্জামানের অভিযোগের সূত্র ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে ছোট মনিরের নামে ইস্যু করা পাসপোর্টে ভিন্ন আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর উল্লেখের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মঙ্গলবার ছোট মনির ও তার ভাই গোলাম কিবরিয়া বড় মনিকে অনেকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।

এর আগে হত্যা ও অস্ত্র চোরাকারবারসহ সাতটি ফৌজদারি মামলার আসামি হয়েছিলেন ছোট মনির। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর।

তবে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ছোট মনিরের পক্ষ থেকে বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ আসনে ছোট মনিরের পাশাপাশি নৌকার প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে খন্দকার মসিউজ্জামান রোমেল।

ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর ছোট মনিরের মনোনয়নপত্র ইতোমধ্যে বৈধ বলে রায় দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। তার দুদিনের মধ্যে খাবিরুজ্জামানের অভিযোগ এল।

খাবিরুজ্জামানের লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইল-২ আসনের প্রার্থী তানভীর হাসান ছোট মনিরের আগের ভোটার নম্বর ছিল ……..০০১০৯৬। এতে ঠিকানা দেখানো হয়েছিল বাজিতপুর রোড, পূর্ব আদালত পাড়া, টাঙ্গাইল সদর, টাঙ্গাইল। কিন্তু ওই একই ভোটার নম্বর ও ঠিকানায় আরেকজনের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে।

“পরবর্তীতে ছোট মনিরের নামে ইস্যুকৃত জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ….০০০০১৫, আর ভোটার নম্বর ০০০২২৬।”

এই অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে গিয়ে ছোট মনিরের ভিন্ন আরেকটি এনআইডি নম্বর ব্যবহারের সন্ধান পাওয়া যায়।

টাঙ্গাইলের ওই ব্যক্তির অভিযোগ অনুযায়ী, ছোট মনিরের বর্তমান এনআইডি নম্বরের শেষ ছয় সংখ্যা হলো ০০০০১৫।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছোট মনিরের ২০১৭ সালের পাসপোর্টে যে এনআইডি নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে, তা ভিন্ন। সেই এনআইডি নম্বরের শেষ ছয়টি সংখ্যা হল ০১০৪৩৪।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট মনিরের এই পাসপোর্টের একটি অনুলিপি তার ভাই বড় মনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পাঠান।

ছোট মনিরের নামে খোলা একটি ফেইসবুক গ্রুপ পেইজে দেওয়া হয়েছে তার পাসপোর্টের ছবি, যেখানে এনআইডি নম্বরের শেষ ছয়টি সংখ্যা ০১০৪৩৪; যা তার বর্তমান এনআইডি নম্বরের সঙ্গে মেলে না

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এনআইডির উপ-পরিচালক ইকবাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক ব্যক্তির একাধিক এনআইডি নম্বর থাকার কোনো সুযোগ নেই। তবে লেমিনেটেড এনআইডি (১৩ ও ১৭ ডিজিটের) ও স্মার্ট এনআইডির নম্বর ভিন্ন হতে পারে।”

১৩ ডিজিটের এনআইডি নম্বরে জন্মসাল থাকে না, কিন্তু ১৭ ডিজিটের এনআইডিতে জন্ম সাল থাকে।    

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অভিযোগদাতার দেওয়া ও পাসপোর্টে পাওয়া ছোট মনিরের নামে দুটি এনআইডি নম্বরই ১৭ ডিজিট বা সংখ্যার। জন্ম তারিখসহ প্রথম সাতটি ডিজিট অভিন্ন হলেও পরের ১০ সংখ্যায় কোনো মিল নেই।

গত ২২ নভেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ছোট মনিরকে নিয়ে “‘অস্ত্র চোরাকারবারি’র নৌকার প্রার্থিতার খবরে এলাকায় ‘আতঙ্ক’” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপরই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদককে ফোন করে মামলার ভয় দেখাতে শুরু করেন ছোট মনিরের ভাই বড় মনি।

নিজেকে ছোট মনিরের মুখপাত্র দাবি করা বড় মনি পরদিন ওই সংবাদের প্রতিবাদপত্র নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে হাজির হন। তিনি নিজেকে টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সদস্য পরিচয় দেন।

খাবিরুজ্জামান গত রোববার তার অভিযোগ নিয়ে টাঙ্গাইলের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গেলে এনআইডি জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে; রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ আমলে নেননি বলে দাবি খাবিরুজ্জামানের। 

এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য রোববার ছোট মনিরের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

পরে ওই দিনই বড় মনি ভাইয়ের এনআইডি ও পাসপোর্ট নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাব দেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই-তিন বছর আগে এনআইডির জন্য ছোট মনির আবেদন করেন এবং এ বছর এনআইডি হাতে পান।”

তাহলে ২০১৭ সালের পাসপোর্টের এনআইডি কোথায় পেলেন- এ প্রশ্নের জবাবে প্রথমে বড় মনি বলেন, “আগের পাসপোর্ট  দিয়ে করা হয়েছে।”

আগের পাসপোর্টও কি এনআইডি ছাড়াই হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আগের পাসপোর্ট জার্মানি থেকে তৈরি করা।”

বড় মনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তার ভাইয়ের দুটি পাসপোর্টের (২০১৭ ও ২০১২ সালের) প্রথম দুই পৃষ্ঠার ছবি পাঠিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের পাসপোর্টে এনআইডি নম্বর ….০১০৪৩৪ ব্যবহার করা হয়েছে।

পাসপোর্ট পাঠানো এবং এনআইডি নিয়ে প্রশ্ন আসার পর থেকেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফোন আর ধরছেন না ছোট মনি ও বড় মনি। রোববার রাতে, সোমবার ও মঙ্গলবার বেশ কয়েকবার ফোন করা হলে ধরেননি এবং মেসেজ পাঠানো হলেও উত্তর দেননি।

তানভীর হাসান ছোট মনির (ফেইসবুকে পাওয়া ছবি)

বড় মনির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে ছোট মনির দেশ ছেড়ে জার্মানি চলে যান।

এই জার্মানি থেকেই ২০১৬ সালে খেলনা পিস্তলের নামে অস্ত্র চোরাচালানের সময় শাহজালাল বিমানবন্দরে দুই জার্মান নাগরিক প্রেপ্তার হন। পরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই জার্মান অস্ত্র, মদ, বৈদেশিক মুদ্রা চোরাচালানে ছোট মনিরের নাম বলেছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, “বিমানবন্দরে কর্মরত এনএসআই ও ডিজিএফআই প্রতিনিধি কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্রগুলো প্রাথমিকভাবে পরীক্ষায় প্রকৃত আগ্নেয়াস্ত্র বলে মৌখিকভাবে মতামত প্রদান করে।”

ওই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামিরা জামিন নিয়ে ফেরারি হয়ে যায়। পরে আমরা তাদেরকে পাইনি। আগ্নেয়াস্ত্রগুলোকে তারা খেলনা হিসেবে প্রমাণ করে।”

বিমানবন্দর থানায় পুলিশের করা ওই মামলার এজাহারে প্রকৃত অস্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হলেও সিআইডির ফরেনসিক প্রতিবেদনে সেগুলোকে ‘ব্ল্যাংক ফায়ারিং পিস্তল’ দেখানো হয়।

“বিভিন্ন পক্ষকে ম্যানেজ করে পার পেয়ে যায়,” বলেন ওই কর্মকর্তা।

কীভাবে পাসপোর্ট পেলেন ছোট মনির?

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে পাসপোর্ট নিতে এসেছিল। আমাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে তাকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছিল।”

ছোট মনিরের সব তথ্য ‘ঠিকঠাক’ দেখে তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

লুকোচুরি কেন?

খাবিরুজ্জামান দাবি করেছেন, ছোট মনির তার বর্তমান এনআইডির তথ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘উচ্চ মাধ্যমিক’ উল্লেখ করলেও নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে ‘সাক্ষরজ্ঞান’ সম্পন্ন ব্যক্তি বলে তথ্য দিয়েছেন।

ছোট মনিরের নাম তানভীর হাসান ছোট মনির বলে এতদিন উল্লেখ করা হলেও এখন সব ক্ষেত্রে কেন শুধু ‘ছোট মনির’ নাম ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

বড় মনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদের যে প্রতিবাদ পাঠিয়েছিলেন, সেখানেও নিজের ভাইকে ‘তানভীর হাসান ছোট মনির’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রচার-প্রচারণায়ও ‘তানভীর হাসান ছোট মনির’ নামই ব্যবহার হয়ে থাকে।

কিন্তু দাপ্তরিক সব কাজে শুধু ‘ছোট মনির’ উল্লেখ করে নাম নিয়ে লুকোচুরির পেছনে কোনো ঝামেলা রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে বড় মনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এনআইডিতে ছোট মনিরের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক বলা হয়েছে, সেটা সঠিক নয়। সেটি সংশোধনের জন্য এ বছরের ৩১ জুলাই আবেদন করা হয়েছে। তার সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমার ছোট ভাই স্থানীয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সে তানভীর হাসান ছোট মনির নামে পরিচিত। পাসপোর্টে তার নাম ছোট মনির উল্লেখ রয়েছে। তার অন্য কোনো নাম কোথাও উল্লেখ নেই। তাছাড়া ছোট মনিরের অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্বও নেই।”

খাবিরুজ্জামান অভিযোগপত্রে দাবি করেছেন, “এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, তিনি (ছোট মনির) হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন এবং ভোটার নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে প্রতারণা করেছেন। তার এই কার্যক্রম জাতীয় সংসদ আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।”

এই কারণে ছোট মনিরের মনোনয়নপত্র বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন খাবিরুজ্জামান।