সাত খুন: হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে দেওয়া হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2018, 01:46 PM
Updated : 19 Nov 2018, 01:46 PM

সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সাত খুনের ঘটনার দুটি মামলার আপিল রায় আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, একটি মামলার রায় ৭৮৩ পৃষ্ঠার; অন্যটি ৭৮১ পৃষ্ঠার।

গত বছরের ২২ আগস্ট হাই কোর্ট সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করে। সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড সেখানে বহাল রাখা হয়।

জজ আদালতে যে ২৬ আসামিকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় হাই কোর্টে। আর নিম্ন আদালতে নয়জনকে দেওয়া বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের রায় বহাল থাকে।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা যদি মনে করেন, তাহলে আপিল করবেন। বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হলে তিনি যদি আপিল বিভাগে আপিল করেন, অ্যাজ এ মেটার অব লাইফ শুনানির অধিকার তার আছে। সুতরাং আপিল ফাইল করলেই আপিল হিসেবে ট্রিট করা হবে এবং শুনানি হবে।” 

অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে মেলে লাশ

সাত খুন

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে অপহরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে।

ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন।

তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে মেলে ছয়জনের লাশ। ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশও নদীতে ভেসে ওঠে। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই হত্যাকাণ্ডে এলিট বাহিনী র‌্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি সে সময় শিরোনাম হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।

হাই কোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১৫ আসামির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি।

সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া সামরিক বাহিনীর সাবেক তিন কর্মকর্তার মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ওই হত্যাকাণ্ডের সময় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা।

র‌্যাবের ক্যাম্প কমান্ডার আরিফ হোসেন ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর। আর মাসুদ রানা ছিলেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন সশস্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্য।

নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি এ মামলার রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেন।

আসামিদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের হাই কোর্ট বেঞ্চ ওই বছর ২২ অগাস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে এবং ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের ফাঁসির রায় বহাল রয়েছে

র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানার মৃত্যুদণ্ডও বহাল রয়েছে

পর্যবেক্ষণ

হাই কোর্টের রায় ঘোষণার দিন আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।”

নূর হোসেনকে ওই হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে বর্ণনা করে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের দ্বন্দ্বের জেরেই সাত খুনের ঘটনা ঘটে। আর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য নূর হোসেনের সঙ্গে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার অবৈধ অর্থিক লেনদেন হয়েছিল।

“কিছু উচ্ছৃঙ্খল র‌্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিস্যাৎ হতে পারে না। কিন্তু এই বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অপরাধবৃত্তি মানব সভ্যতায় আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা এতটাই পাশবিকতা দেখিয়েছে, যা ছিল নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।”

রায়ের পর্যবেক্ষণে সেদিন বলা হয়, “র‌্যাব রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বিশেষ বাহিনী। তাদের দায়িত্ব হল জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু এ বাহিনীর কিছু সদস্য নৃসংশ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পরে অপরাধ ঘটিয়েছে। ফলে তাদের বিচার হয়েছে।”

র‌্যাব হেফাজতে সাতজনকে হত্যার বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা ছিল ভয়বহ, অচিন্তনীয়। র‌্যাব সদস্যরা এতটাই নির্দয় ছিল যে, হত্যার পর তাদের তলপেট ছুরি দিয়ে কেটে বস্তাবন্দি করে তার সঙ্গে ১০টি করে ইট বেঁধে দেওয়া হয়, যেন বস্তাবন্দি লাশ নদীর পানিতে তলিয়ে যায়।”

আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “এই হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। তাদের নৃসংশতা প্রমাণ করে, মৃতদেহের উপরও তারা কতটা নির্দয় ছিল।”

র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য অপরাধ করলেও নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এ বাহিনীর ওপর দেশের মানুষের ‘যথেষ্ট আস্থা’ রয়েছে মন্তব্য করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “কতিপয় সদস্যের কারণে সামগ্রিকভাবে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না।”

আসামিপক্ষ শুনানিতে দাবি করে, এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষ্য নেই, আর্থিক লেনদেনেরও কোনো প্রমাণ নেই।

এ বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “র‌্যাবের তখনকার এডিজি জিয়াউল হাসান টাকা লেনদেনের বিষয়ে মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এছাড়া নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম তারিক সাঈদের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, নূর হোসেন যত টাকা দিয়েছে তার চেয়ে বেশি টাকা দেবেন, নজরুলকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।

“এ থেকে প্রমাণ হয়, টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তাছাড়া বেআইনি লেনদেনের সাধারণত কোনো প্রমাণ থাকে না।”

১১ জনের সাজা কমানোর বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “অপরাধের ধরন বিবেচনায় নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। অপরাধের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা হয়েছে। কিন্তু তারা যে অপরাধ করেছে, তাতে যাজজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তা হত কঠোর শাস্তি।”