শ্যামনগরে হরিণ শিকার: বিচারিক তদন্তের নির্দেশ

শ্যামনগরে সুন্দরবনের ‘২২টি হরিণ শিকারের’ ঘটনা অনুসন্ধান করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2018, 02:38 PM
Updated : 12 Nov 2018, 02:38 PM

সেই সঙ্গে আইন ও বিধি অনুযায়ী সুন্দরবন সংরক্ষণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছে আদালত।  

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক, প্রধান বন সংরক্ষক, সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, শ্যামনগর থানার ওসিসহ ১৬ বিবাদীকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার রুলসহ এ আদেশ দেয়।

সুন্দরবন থেকে ২২টি হরিণ শিকারের খবর গত ৯ ও ১০ জুলাই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পরে বণ্যপ্রাণী ও বন সুরক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে গত ২৫ জুলাই শ্যামনগরের বাসিন্দা ও সাপ্তাহিক নয়া বার্তার সম্পাদক আবু বকর জনস্বার্থে এই রিট আবেদন করেন।

রিট আবেদনকারী পক্ষে হাই কোর্টে শুনানি করেন আইনজীবী শামছুল হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।    

আদেশের পর মোতাহার হোসেন সাজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২২টি হরিণ শিকারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোস্ট গার্ড, বন বিভাগ, প্রশাসন ও সাংবাদিকদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছে, তা সংরক্ষণ করতেও বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

আগামী বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলাটির পরবর্তী শুনানির জন্য রাখা হয়েছে বলে জানান এই আইন কর্মকর্তা। 

রিটকারীর আইনজীবী শামছুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সুন্দরবনের ভেতরে বা সংরক্ষিত এলাকায় বন্যপ্রাণী হত্যার ঘটনা ঘটলে মামলা করার কথা বন বিভাগের। অথবা বন বিভাগের পরামর্শে প্রশাসনের মামলা করার বিধান আছে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে।

“কিন্তু বন বিভাগ এ ঘটনায় কোনো মামলা করেনি। মামলা করেছেন শ্যামনগর থানার এসআই লিটন দাস। এই লিটন দাসসহ শ্যামনগর থানার আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হরিণ শিকারের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া হরিণ শিকার হয়েছে ২২টি, মামলায় দেখানো হয়েছে তিনটি।”

এ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর যুক্ত করে রিট আবেদনটি করা হয়েছে জানিয়ে শামছুল হক বলেন, “প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত রুলসহ অন্তবর্তীকালীন নির্দেশনা দিয়েছেন।”

‘সুন্দরবনে শ্যামনগর থানা পুলিশের হরিণ শিকার!’ শিরোনামে গত ১০ জুলাই দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিশাল এক বোটে ১৬ খণ্ড বরফ নিয়ে গভীর সুন্দরবনে হরিণ শিকার করলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার ছয় পুলিশ সদস্য ও তাদের সহযোগীরা। কিন্তু মধ্যরাতে বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে শেষ পর্যন্ত শিকারি পুলিশ সদস্যরা হয়ে গেলেন ‘অভিযানকারী’।

“আর তাদের হাতে গ্রেপ্তার হল দুই শিকারি। জব্দ হয়েছে তিনটি শিকারকৃত হরিণ ও তিনটি বন্দুক। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে। হরিণ শিকারে নিরাপত্তা ও নেতৃত্বদানকারীরা হলেন- শ্যামনগর থানার এসআই লিটন, এসআই হাফিজ, দুই এএসআই মামুন ও ফজলুল করিম এবং কনস্টেবল আলমগীর ও কনস্টেবল উত্তম কুমার। তারা গ্রেপ্তার দেখালেন শ্যামনগরের কদমতলির হরিণ শিকারি মঞ্জু ও পাতাখালির মহিবুল্লাহকে।”

ঘটনার বর্ণনায় ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্যামনগর থানার ছয় পুলিশ সদস্য সুন্দরবনের গহীনে বোট নিয়ে হরিণ শিকারের লক্ষ্যে একটি শিকারি দলের নেতৃত্ব দেন। ওই বোটে ছিলেন ভাড়াটে শিকারি পাতাখালির আজিজ, রমজাননগর ইউপির সাবেক মেম্বর শিকারি আনারুল ও হরিনগরের শিকারি আবদুল আলিম। এছাড়া ছিলেন কয়েকজন শ্রমিক।

“তিন দিনে অন্তত দশটি হরিণ শিকার করে বরফাচ্ছাদিত করে রোববার রাত ১২টার দিকে ফিরে আসছিল শিকারি দলটি। কিন্তু বিধি বাম। খবর পেয়ে বন বিভাগ ও কোস্টগার্ড সদস্যরা বনের চুনকুড়ি নদী ও দোবেকির মধ্যবর্তী স্থানে শিকারি পুলিশ দলের মুখোমুখি হয়।

“তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বোট, হরিণ বন্দুক ও পুলিশ সদস্যসহ সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় বন বিভাগের দোবেকি স্টেশনে। সেখানে বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডকে বোঝানো হয়, পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেছে এবং হরিণ ও বন্দুক জব্দ করেছে।”

খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বসিরুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “৯ জুলাই ভোরে টেলিফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি খবর পেয়েছি দুটি শিকার করা হরিণ ও তিনটি বন্দুক জব্দ করেছে পুলিশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ বলছে তারা অভিযান চালাতে গিয়েছিল। তাদের কথা তো আর অবিশ্বাস করা যায় না’।”

শ্যামনগর থানার ওসি সৈয়দ মান্নান আলিকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, “সুন্দরবনের ঘটনাস্থল থেকে আমার থানার এসআই লিটন জানিয়েছেন, রোববার (৮ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টার দিকে মেঘনা নদীর মোহনায় একটি বোট দ্রুত গতিতে যেতে দেখে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন। পরে ওই বোটে তল্লাশি চালিয়ে তিনটি শিকারকৃত হরিণ ও তিনটি একনলা বন্দুক পাওয়া যায়। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় আজিজ ও আনারুলকে। অন্যরা পালিয়ে যায়।

“ওসি আরও বলেন, এ বিষয়ে বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ তারাও একই স্থানে অভিযান চালাতে গিয়েছিলেন। তবে ওসির কাছে জানতে চাওয়া হয় এসআই লিটন যে বোট নিয়ে কথিত অভিযান চালান, সেখানে ১৬ খণ্ড বরফ কেন ছিল এবং তারা তিন দিন আগে হরিণ শিকারি দলের সঙ্গে কেন বনে গেছেন। এর কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি ওসি। তবে তিনি হরিণ শিকারে তার পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।”

রিটকারী আবু বকর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বেলেন, “এ ঘটনায় বনবিভাগকে মামলা করতে না দিয়ে শ্যামনগর থানার এসআই লিটন নিজেই বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। সেখানে কেবল তিনটি হরিণ ও তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার দেখানো হয়। আর আসামি করা হয় কেবল ছয়জনকে।”

এ মামলা তদন্ত করে পুলিশ ইতোমধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে বলেও জানান রিটকারী।