ভোট চলছে তিন নগরে

জাতীয় নির্বাচনের মাত্র মাস ছয়েক বাকি থাকতে সিটি করপোরেশনের নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে ভোট দিচ্ছে দেশের তিন অঞ্চলের তিন নগরীর প্রায় নয় লাখ ভোটার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2018, 02:01 AM
Updated : 30 July 2018, 07:19 AM

রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটে সিটি করপোরেশনের ৩৯৫টি কেন্দ্রে সোমবার সকাল ৮টায় নির্ধারিত সময়েই ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে বলে দায়িত্বে থাকা নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।  

ইসি সচিবালয়ের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখার উপ সচিব ফরহাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুন্দরভাবে ভোট শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত সব জায়গায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। কোথাও কোনো ঝামেলার তথ্য পাওয়া যায়নি।“

বছর শেষে সংসদ নির্বাচনের আগে এই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনই কার্যত নৌকা ও ধানের শীষের শেষ লড়াই। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় এই নির্বাচন ঘিরে কোনো সহিংসতা না ঘটলেও পাল্টাপাল্টি বক্তব্যই ছড়িয়েছে উত্তাপ; যা জাতীয় নির্বাচনের একটি আবহ তৈরি করেছে।

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের ভাষায়, “সবার নজর এ নির্বাচনের দিকে। রাজনৈতিক দল, ভোটার, পর্যবেক্ষক সবাই তাকিয়ে রয়েছে। কারণ, তিন সিটি ভোটের ফল জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে। এখানে যারা জিতবে, তারাই আগামী নির্বাচনেও জয়ের সুবাস পাবে।”

শুধু তাই নয়, খুলনা ও গাজীপুরের ভোট নিয়ে ইমেজ সঙ্কটে পড়া বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এই নির্বাচনে চোখ রাখছে বিদেশিরাও। এই তিন সিটিতে নির্বাচন যেন উৎসবমুখর পরিবেশে হয় এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই প্রত্যাশা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র ‍ও নেদারল্যান্ডস দূতাবাস।

গোটা দেশের ১০ কোটিরও বেশি ভোটারের নজরও এখন এই তিন সিটির দিকে। তিন নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে ভোট শুরুর আগে থেকেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকতে দেখেছেন আমাদের প্রতিবেদকরা। 

ইসির উপ সচিব ফরহাদ হোসেন বলেন, “আধ ঘণ্টা পর নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে। দিনভর নির্ধারিত সময় পর পর  প্রতিবেদন পাব আমরা। পরিস্থিতি তদারকিতে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইন শৃঙ্খলা সমনন্বয় সেল ও মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।”

পাঁচ বছর আগে এই তিনটি নগরীতেই বিএনপি প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে মেয়রের আসনে বসেছিলেন। এবার ধানের শীষ প্রতীকে রাজশাহী ‍ও সিলেটে প্রার্থী হয়েছেন সেই বিজয়ী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও আরিফুল হক চৌধুরীই। তাদের বিপক্ষে নৌকার প্রার্থী হয়ে লড়ছেন সেই আগের দুজনই এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।

 

তবে বরিশালে বিএনপি প্রার্থী বদলে এনেছে কেন্দ্রীয় নেতা মজিবুর রহমান সরওয়ারকে, যিনি বরিশাল সিটি করপোরেশনে প্রথম নির্বাচিত মেয়র; সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এনেছে নতুন প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদেক আবদুল্লাহকে, ভোটে নতুন হলেও রাজনীতিতে তার পরিবার অনেক পুরনো।

এই তিনটি নগরীর আগে কুমিল্লা ও রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি প্রশংসা কুড়ালেও গত তিন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তাদের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

সহিংসতা কিংবা ব্যাপক ভোট কারচুপির দৃশ্য দেখা না গেলেও ২০১৩ সালে জেতা ওই দুটি মেয়রের পদ হারিয়ে বিএনপি অভিযোগ তোলে, প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারে কৌশলে তাদের হারানো হয়েছে।

এই তিন সিটিতে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরাও একই আশঙ্কার কথা বলছেন। বুলবুল, আরিফুল, সরওয়ার তিনজনই বলছেন, তাদের প্রচার চালাতে দেওয়া হচ্ছে না, পুলিশের গ্রেপ্তার-হয়রানি থেকে বাদ যাচ্ছেন না ধানের শীষের পোলিং এজেন্টরাও।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এসব অভিযোগের পাল্টায় বলেছেন, সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণ নৌকায় ভোট দিচ্ছেন, আর পরাজয়ের আভাস পেয়ে আগে থেকে অভিযোগ তুলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন বিএনপি নেতারা। 

সিলেটে নৌকার প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলছেন, “বিএনপি এখন জনবিচ্ছিন্ন, তাই তারা অমূলক কথাবার্তা বলছে। মিথ্যা অভিযোগের কথা বলে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করছে তারা।”

ইসি অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই খুলনা ও গাজীপুরের ভোটে অনিয়মের দিকটি চিহ্নিত করেছেন; যদিও তা ফলাফল পাল্টে দেওয়ার মতো ছিল না বলেও মত দিয়েছেন তারা। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, তারপরও ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। 

তিন সিটিতে ভোটের আগের দিনও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সিইসির সঙ্গে দেখা করে নানা অভিযোগ দিয়ে আসে। তবে সেই সঙ্গে তারা এটাও বলেছে, সমাধান হবে না বলেই ধারণা করছেন তারা।

রোববার ইসিতে বৈঠকের পর দলটির যুগ্মমহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন কমিশন আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখতে পারছি না।”

তাহলে কেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ- তার উত্তরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এদিন এক সভায় বলেন, “তাদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য আমরা বার বার নির্বাচন করছি।”

অর্থাৎ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না বলে যে বক্তব্য সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি দিয়ে আসছে, তার নজির হিসেবে এই নির্বাচনগুলোকে দেখাতে চাইছে তারা।

প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, বিএনপি জিতলে নির্বাচনকে ভালো বলে, আর হারলে বলে খারাপ।

“আমরা যদি জিতি তাহলে ওয়েলকাম, হেরে গেলেও লজ্জা নাই। রাজনীতির জোয়ার ভাটা ... আমাদের কি ভাটা আসতে পারে না? আমরাই জিতব এ অহংবোধ আমাদের মধ্যে নেই।“

আওয়ামী লীগ নেতারা আশাবাদী জয়ের বিষয়ে, আর একটি জরিপের ফল দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলছেন, তিন নগরের দুটিতেই অনায়সে জয় আসবে নৌকার প্রার্থীর, বাকি একটি সিলেটে লড়াই করে জিততে হবে।

ভোটের আগের দিন রোববার নিজের ফেইসবুক পেইজে রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (আরডিসি) করা ওই জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন জয়।

তার ভাষায়, “নির্বাচনী লড়াইয়ে বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের জন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই না।”

দুই প্রধান দলের কথার উত্তেজনার মধ্যে এই তিন সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু করার সব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে ইসি। 

নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ থাকবে। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়েছি।”

জাতীয় নির্বাচনের আগে এই তিন সিটি ভোটের গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাও। এ সিটি নির্বাচন যাতে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেই নির্দেশনাই সংশ্লিষ্টদের দিয়েছেন তিনি।

মেয়র পদে তিন সিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ১৯ জন। নির্বাচনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকছেন পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার-ভিডিপির ১৭ হাজার ৪৮৭ জন সদস্য।

ভোটের আগের দিন রোববার বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী এলাকায় বিজিবির টহল

নির্বাচন পরিচালনায় থাকবেন প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারসহ সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা।

আর বিভিন্ন সংস্থার ৬০৯ জন পর্যবেক্ষক এবং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের ছয় শতাধিক সাংবাদিক এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস, ইউএসএআইডি ও ডিআই-এর পর্যবেক্ষক থাকবেন ১৮ জন।

তিন নগরীতে এ নির্বাচন পরিচালনায় ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা।

জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারই  ইসির লক্ষ্য।

সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, “অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এ সিটি নির্বাচনের ফল জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে। প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক ভোট হচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচনেও ইতিবাচক বার্তা দেবে।”

ভোটারদের প্রত্যাশাও তাই। সিলেটের আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য শেখ জালাল আহমেদ জলিলের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় অন্য নগরী দুটির ভোটারদের মধ্যেও।

“আমরা চাইতাছি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। কোনো ফিৎনা-ফ্যাসাদ যেন না হয়,” বলেন বর্ষীয়ান এই ভোটার।

আরও পড়ুন