গোয়েন্দা জালাল খুন: হোতা ‘চিহ্নিত’, সহযোগী ৪ জন

ঢাকার মিরপুরের পীরেরবাগে অভিযানের সময় গোয়েন্দা কর্মকর্তা জালাল উদ্দিনকে গুলি করে হত্যার ঘটনার হোতাকে চিহ্নিত করার দাবি করেছে পুলিশ।

অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 March 2018, 03:56 PM
Updated : 23 March 2018, 04:15 AM

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসান (২৪) নামে এক যুবক এই হত্যাকাণ্ডের হোতা, তার সঙ্গে ছিল আরও অন্তত চারজন।”

সোমবার রাতে অভিযানে অংশ নেওয়া এই কর্মকর্তা জানান, ঘটনার সময় পুলিশও ৩০ থেকে ৪০ রাউন্ড গুলি করে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা দ্রুতই পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়।

পুলিশ হাসানের স্ত্রীসহ পরিবারের চার সদস্যকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলেও জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

একতলা ভবনের ছাদে তিনটি ঘরের মধ্যে একটিতে থাকতেন হাসান। অন্য দুটি ঘরের ভাড়াটিয়াদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

তবে ওই দুটি ঘরের ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের যোগসূত্র পাওয়া যায়নি বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”

ট্রাফিক পুলিশের দুই সার্জেন্টের মিরপুরের বাসা থেকে অস্ত্র চুরির তদন্তে পীরেরবাগের ওই বাড়িতে সোমবার রাতে অভিযানে গিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ।

গত ১০ জানুয়ারি দুই সার্জেন্টের অনুপস্থিতিতে তাদের ভাড়া বাসা থেকে দুটি পিস্তল চুরি হয়ে যায়। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।

অভিযানে অংশ নেওয়া এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, কিছুদিন আগে একজন অপরাধীকে গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তার তথ্যের ভিত্তিতে পীরেরবগের ওই বাসায় সার্জেন্টদের অস্ত্রগুলো আছে ধারণা নিয়ে সার্বিক তথ্য সংগ্রহ (রেকী) করতে ১০ জনের একটি দল সেখানে গিয়েছিল।

অভিযানের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “ভবনের কলাপসিবল গেইট খোলার জন্য কাউকে না পাওয়ায় একজনকে ডাকতে জানালার শেডে উঠতে চান অভিযানে থাকা একজন সহকারী কমিশনার। কিন্তু জালাল উদ্দিন তাকে উঠতে না দিয়ে নিজেই উঠে পড়েন।

“এরই মধ্যে ছাদ থেকে বেশ কয়েকটি ইট ছুড়ে মারলে জালাল উদ্দিন সেখান থেকে পড়ে যান। পরে উপর থেকে পরপর বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করলে অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যরা হকচকিয়ে যান। নিজেদের নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাল্টা গুলি করেন। এরই মধ্যে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলি  জালাল উদ্দিনের মাথায় লাগে।”

মো. জালালউদ্দিন

রক্তাক্ত জালালকে সঙ্গে সঙ্গে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান সহকর্মী কয়েকজন। অন্যরা পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে। এরই মধ্যে থানা পুলিশ ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল সেখানে উপস্থিত হয়। কিন্তু পরে তল্লাশি চালিয়ে কাউকে পায়নি।

ওই কর্মকর্তার ধারণা, জালাল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই সন্ত্রাসীরা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়।

হাসানের বিরুদ্ধে আগের কোনো ঘটনায় মামলা আছে কি না, তা খুঁজে দেখছে পুলিশ।

গোয়েন্দা পরিদর্শক জালালের মাথায় দুটি গুলি লাগে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে জানাজা শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, “জালাল উদ্দিন নিজ পেশায় সততা থেকে দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে এই দুস্কৃতিকারিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করব।”

‘রাতে ফিরতে পারব না’

সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় স্ত্রী বীনা পারভীনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে শেষ কথা হয় গোয়েন্দা পরিদর্শক জালাল উদ্দিনের। তখন তিনি বলেছিলেন, রাতে ফিরতে পারছেন না তিনি, ঘরে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে।

তখন অভিযানে ছিলেন জালাল, ওই অভিযানেই তার মৃত্যু ঘটে।

এর আগে সন্ধ্যায় স্ত্রীকে ফোন করে নিজের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধের নামটি জেনে নিয়েছিলেন জালাল।

তার শ্যালিকা রিম্পা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিন দিন আগে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন, তখন ডাক্তার তার প্রেসারের ওষুধ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। নতুন এই ওষুধের নামটি জানা না থাকার কারণে ফোন করে জেনে নিয়েছিলেন।”

জালাল সাধারণত সাড়ে ১২টার মধ্যে বাসায় ফিরতেন। বাসায় যতক্ষণ থাকতেন দুই মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। একটি মেয়ে দশম শ্রেণিতে এবং অন্যটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

রিম্পা খাতুন জানান, সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে দুই সন্তানকে নিয়ে প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে গিয়েছিলেন তার ভগ্নিপতি। তাদের কোচিংয়ে রেখে অফিসে চলে যান। এরপর বীনাই সন্তানদের কোচিং থেকে স্কুলে নিয়ে যান এবং বাসায় নিয়ে আসেন।

রাত ১টার পর একটি ফোন পেয়ে সন্তানদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান বীনা। তখন তাকে মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি। শুধু বলা হয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছে।

রিম্পা খাতুন বলেন, “মেয়ে দুটো ভিকারুন্নেসায় পড়লেও শুধু অর্থের কারণে ওই এলাকায় না থেকে কম টাকায় বাসাবোয় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছিলেন তিনি (জালাল)।”

স্বামীর মৃত্যুতে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন বীনা জানাজায় আইজপিকে পেয়ে তাকে নিজের উদ্বেগের কথা জানান।  

জানাজা শেষে কথা বলতে গেলে আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীকে তিনি বলেন, “মেয়েদের ডাক্তার হওয়ার যে স্বপ্ন  তাদের বাবা দেখতেন, তা যেন বাস্তবায়িত হয়।”

আইজিপি এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, পুলিশের সব সদস্য এই পরিবারের সঙ্গে থাকবে।

এসময় বীনা পারভীনের হাতে আইজি এবং পুলিশ কমিশনার পৃথকভাবে তাৎক্ষণিক ব্যয় বহনের জন্য নগদ টাকা তুলে দেন।