মেলায় এবার একুশের বই ১৬টি

সাহিত্যের সবগুলো শাখায় একুশের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়ে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এবার পৌনে চার হাজার নতুন বই এলেও তার মধ্যে একুশের বই মাত্র ১৬টি।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2018, 04:57 AM
Updated : 20 Feb 2018, 04:57 AM

প্রকাশকরা বলছেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও পূর্বাপর নিয়ে যথাযথ পাণ্ডুলিপি আর গবেষণার অভাবে তারা বই প্রকাশ করতে পারছেন না। 

আবার ভাষা আন্দোলন নিয়ে বইয়ের কাটতি না থাকায় প্রকাশকরা আগ্রহী হন না- এমন কথাও এসেছে।

ভাষা আন্দোলনের বই প্রকাশে প্রকাশকদের এমন অনীহায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ভাষা সংগ্রামী, গবেষক-প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক।

তার মতে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশের ‘প্রধান’ প্রতিবন্ধকতা।

“যে চেতনায় বাংলা ভাষার দাবি সেদিন পূরণ হয়েছিল, সেই চেতনা বাঙালি পুরোপুরি ধারণ করছে না। সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়নের প্রভাবে হোক, কিংবা সদিচ্ছা বা আন্তরিকতার অভাবে- সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ তো হচ্ছে না।”

সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে একুশে পদক পাওয়া আহমদ রফিক সোমবার বইমেলায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজনৈতিক দল বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বাংলা ভাষার চেতনা ছড়িয়ে দিতে জোরালো উদ্যোগে না নেওয়ায় নতুন ও তরুণ প্রজন্ম ইংরেজি ভাষার দিকে বেশি ঝুঁকছে। ফলে একুশের চেতনা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে।

“অমর একুশে গ্রন্থমেলা এ দেশের অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলা। এ মেলায় বই বিক্রি মূল বিষয় নয়। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে বাঙালির বেদনা ও গৌরবগাথা।”

আহমদ রফিক বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে মানুষের মাঝে আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে ভাষা চেতনা। কিন্তু সেই চেতনা এই মাসে মানুষের মাঝে যেভাবে কাজ করে বাকি এগারো মাস তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।”

ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “তারা তাদের মাতৃভাষাকে, রাষ্ট্রভাষাকে জীবিকার প্রধান মাধ্যমে পরিণত করেছে। ওই ভাষা জানলে অন্য ভাষা না জেনেও তারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারে। আমরা সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারিনি। বিদেশি ভাষার নির্ভরতা কমাতে পারিনি। ”

ভাষা আন্দোলন নিয়ে সাহিত্য রচনা বা গবেষণায় যে নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও তা মানছেন। 

“একুশ নিয়ে বাঙালির আগ্রহ অনেক বেশি, উচ্ছ্বাসও অনেক বেশি। কিন্তু সেই আবেগের গভীরতা অনেক কম। একুশ নিয়ে সত্যি নতুন কিছু করার পরিকল্পনা খুব কম। এ নিয়ে আরও কাজ করার রয়েছে।”

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে আরও বিশদ, বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরা প্রয়োজন।

“যত দিন যাবে, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিগুলো হারিয়ে যেতে বসবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনেক তথ্যের ভিড়ে আমাদের ইতিহাস স্রষ্টারাই না কবে হারিয়ে যান।

“তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের সামনে আরও বিশদ আকারে উপস্থাপন করতে হবে। ইতিহাস পাঠে তাদের উৎসাহী করে তুলতে আমাদের সাহিত্যের যতগুলো শাখা রয়েছে, চলচ্চিত্র রয়েছে, সবগুলোতেই আমাদের আরও অনেক কাজ বাকি।”

ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর নিয়ে অনেক অজানা ইতিহাসের অনুসন্ধানে তরুণ প্রজন্মের গবেষকদেরও কাজ করার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন গোলাম কুদ্দুছ।

পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের ওপর শিশু-কিশোরদের উপযোগী বই প্রকাশ করার বিষয়েও জোর দেন তিনি।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশে অনীহার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, “ভাষা আন্দোলন, আন্দোলনের নেতা, পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা যা প্রকাশ হওয়ার তা হয়ে গেছে।”

তবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন কোনো গবেষণা, কোনো নতুন আঙ্গিকের রচনা পেলে প্রকাশকরা তা ছাপতে ‘আগ্রহী হবে’ বলে মনে করেন প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল।

তিনি বলেন, “ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা কখনো থেমে যাবে না। এটি চলমান প্রক্রিয়া। নতুন প্রজন্মের সদস্যরাও একদিন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে  বিশ্লেষণ করবে, গবেষণা করবে। পাণ্ডুলিপি পেলে আমরা সেসব  বই ছাপাব।”

এবারের মেলায় ভাষা আন্দোলনের বই

বইমেলার তথ্য কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে আহমদ রফিকের প্রবন্ধ সংকলন ‘ভাষা আন্দোলন: সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে’। প্রথমা প্রকাশ করেছে তার ‘একুশের মুহূর্তগুলো’।

অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে গোলাম কুদ্দুছের শিশু-কিশোরভিত্তিক বই ‘ভাষা আন্দোলন: সহজপাঠ’।

য়ারোয়া প্রকাশ করেছে গোলাম কুদ্দুছের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ’।আর নালন্দা থেকে এসেছে ‘ভাষা আন্দোলন বায়ান্ন পূর্ব’।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে খোরশেদ শফিউল হাসানের ইতিহাসভিত্তিক বই ‘ভাষা সংগ্রামী নাঈমউদ্দীন আহমদ’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারির ষাট বছর’।

সাহিত্যপ্রকাশ থেকে এসেছে রাফিউর রাব্বীর গবেষণা গ্রন্থ ‘নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলন’। গোলাম সারোয়ার মালেকের ‘আমাদের ভাষা শহীদ’ প্রকাশ করেছে বিভাস।

সাহিত্যমালা প্রকাশনী থেকে এসেছে এস এম শাওয়ান মনিরের ‘অনেক ঝড়ে অমর একুশ’, খান শাহিনের উপন্যাস ‘শিশির ভেজা একুশ’ প্রকাশ করেছে বাঁধন।

সিসটেক পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে আবদুল্লাহ সিদ্দিকের কবিতার বই ‘একুশের স্মৃতি’, নন্দিতা প্রকাশ থেকে এসেছে মো. আসকর আলী ফকিরের কবিতার বই ‘রক্তে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি’।

নবরাগ প্রকাশনী থেকে এসেছে জহিরুল হক বাপ্পীর কিশোর উপন্যাস ‘ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তি সংগ্রাম’, সাইফ আবেদীনের শিশুতোষ বই ‘ভাষা আন্দোলনের গল্প’ প্রকাশ করেছে রাবেয়া বুক হাউজ।

আর ভাষা প্রকাশ এনেছে মিজান রহমানের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’।