প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষা অনাবশ্যক: অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যুক্ত করে এই স্তরে পরীক্ষা বাতিলের পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2017, 09:32 AM
Updated : 22 Nov 2017, 04:28 PM

বুধবার সকালে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির ‘সহজপাঠ: শিশুর সামগ্রিক বিকাশ’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্রে যোগ দিয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ তুলে ধরার পাশাপাশি প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সমালোচনা করেন তিনি।

প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষা পদ্ধতির বিরোধিতা করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য ভালো শিক্ষা পাওয়া নয়, তাদের লক্ষ্য কেবল প্রথম হওয়া। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষার কোনো আবশ্যক নেই।”

শিশুদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে ‘আনন্দযোগ নেই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শোচনীয়। এখানে শিশুদের পরীক্ষার নামে রীতিমতো পীড়ন করা হচ্ছে। এতে বিন্দুমাত্র আনন্দযোগ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পরীক্ষাসর্বস্ব, জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আমরা নষ্ট করে ফেলেছি।”

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও শিক্ষাবিদরা যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৃত্যকলা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন, তখন মৌলবাদীদের একটি দল এর বিরোধিতা করে।

তিনি বলেন, “শিক্ষা কমিশন যখন ছড়া, চারুকলা, নৃত্য শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ করার কথা বলছে তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো ভাবনা-চিন্তাই নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সেই অযৌক্তিক কথায় কর্ণপাত করল।”

স্বাধীনতার পর গঠিত কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘নৈতিক শিক্ষা’কে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার কর্মকর্তারা তাদের সেই পরামর্শ উপেক্ষা করে মাদ্রাসায় ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন।

নব্বইয়ের দশকে অধ্যাপক শামসুল হক নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশনেও সদস্য হিসেবে কাজ করা এই এমিরেটাস অধ্যাপক বলেন, “আমরা যতবার পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ ও বদল করতে চেয়েছি, ততবারই আমাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম, পাবলিক পরীক্ষার নম্বরের একটি অংশ স্কুল থেকে আসবে। কিন্তু তা করতে পারিনি।”

সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের শাসনামলে তার এক পরিচিতের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতিতে নতুন ধারা প্রবর্তন করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।

“সে সময়ে নিয়ম হল, কেউ যদি পাবলিক পরীক্ষায় কোনো একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হন, তবে

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (ফাইল ছবি)

পরবর্তী বছরে সেই বিষয়েই পরীক্ষা দিলেই চলবে। অন্য কোনো বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে না তাকে। মজার ব্যাপার হল, এরশাদ সাহেবের কোনো এক পরীক্ষার্থী আত্মীয়ের জন্য এই পদ্ধতি গৃহীত হয়েছিল।”

সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়পক্ষ এখনো খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না বলেও মনে করেন তিনি।

পরে তিনি শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেন।

কবি, সাংবাদিক আবুল মোমেনের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজির অধ্যাপক শাহীন ইসলাম, শিশু অধিকারকর্মী নুরুন্নাহার নূপুর, লেখক আনিসুল হকসহ ‘সহজপাঠ’ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবকরা। 

অধ্যাপক মনজুর আহমেদ শিশুদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর গুরুত্বারোপ করতে অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “শিশুকে তার চিন্তার স্বাধীনতা দিতে হবে। ওর উপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে সে কি বলতে চায়, তা শুনতে হবে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়ে শিশুরা নিজেরা কি ভাবছে, তা আমাদের শুনতে হবে।”

ইউনিসেফের সাবেক এ কর্মকর্তা পরে শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠেন।

“শিশুর মেধা মূল্যায়নের বিভিন্ন প্রক্রিয়া থাকলেও আমরা সেই পরীক্ষা পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছি। শিশুরা স্কুলে এসে কোথায় আত্মবিশ্বাসী হবে, তা না উল্টো মুখস্থ বিদ্যায় জিপিএ-৫ পাওয়ার একটা অনৈতিক প্রতিযোগিতায় নেমেছে।”

স্কুলে পিছিয়ে পড়া শিশুদের ব্যাপারে বাড়তি মনযোগ রাখার পরামর্শ দেন অধ্যাপক শাহীন ইসলাম।

“মেধাবী শিশুদের বাছাই করতে গিয়ে আমরা ক্রমেই তাদের অবহেলা করছি। তাদের সঙ্গে মেধাবীদের একটা বড় দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ওদেরকেও বলতে হবে, ওরা স্পেশাল। ওদের গড়ে তোলার জন্য একটি আলাদা কাঠামো প্রণয়ন করা দরকার।”