বার্তাকক্ষে শিশুপ্রহর

বিশ্ব শিশু দিবসের বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তাকক্ষ ছিল শিশুদের।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2017, 04:08 PM
Updated : 21 Nov 2017, 02:15 PM

নাফিসা ইসলাম তুলতুল, আমিনুর রহমান হৃদয়, সাদিক ইভান, নানজিবা খান আর শিলা আক্তার মৌ-  তারা সবাই শিশু সাংবাদিক। বাংলাদেশে শিশু সাংবাদিকতার প্রথম ওয়েবসাইট হ্যালোর হয়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রতিবেদন তৈরি করে আত্মবিশ্বাসের ছাপ তাদের চোখেমুখে।

সোমবার বিকালে দেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মূল বার্তাকক্ষে তাদের হল নতুন অভিজ্ঞতা। মূল ধারার অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের কাজ দেখে, তাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে আড্ডায় আলোচনায় তারা পেল পেশাদারী সাংবাদিকতার ধারণা।

আগের দিন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসা শিশু সাংবাদিকদের সঙ্গে এক আলোচনায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেছিলেন, সোমবার বিশ্ব শিশু দিবসে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তা কক্ষেও শিশু সাংবাদিকদের পদচারণা থাকবে।

সে অনুযায়ী হ্যালোর শিশু সাংবাদিকের দল যখন সোমবার বিকালে বার্তাকক্ষে হাজির হল, তাদের স্বাগত জানালেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিউজ গ্যাদারিং টিম ম্যানেজমেন্টের সদস্য সুমন মাহবুব।

এরপর ডেস্কে ডেস্কে ঘুরে কাজ দেখার পাশাপাশি হেড অব ইংলিশ নিউজ অরুণ দেবনাথ, হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড এডিটরিয়াল পলিসি কো-অর্ডিনেটর গাজী নাসির উদ্দিন আহমেদ, বার্তা সম্পাদক জাহিদুল কবির ও মুনীরুল ইসলাম, প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক আবদুর রহিম হারমাছি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রতিবেদক সুমন মাহবুবের সঙ্গে কথা হল তাদের। 

বার্তাকক্ষের কাজ নিয়ে আলোচনায় বড়দের সঙ্গে ক্ষুদেরা

কোনটা খবর, কোনটা নয়? সাংবাদিকের কাজটা কী?

‘বড়দের’ সঙ্গে আলাপের ফাঁকে ফাঁকে উঠে ‘ক্ষুদেদের’ কাজের অভিজ্ঞতার কথাও।

ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা সাদিক ইভান জানায়, ২০১৪ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে সে হ্যালোর সঙ্গে যুক্ত।

গাজীপুরে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য শৌচাগার না থাকার বিষয়টি তার প্রতিবেদনে উঠে এলে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট বানাতে উদ্যোগী হয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।

আবার স্কুলের আঙিনায় প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ে করা ইভানের আরেকটি প্রতিবেদন সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও নজর কেড়েছিল।

হলিক্রস কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম তুলতুল সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই হ্যলোতে যুক্ত হয়েছিল রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে। তার অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয়েছে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নীতির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিবেদন করে কর্তৃপক্ষের সাড়া পাওয়ার আনন্দ।

শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে এক অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও প্রশ্ন করার সুযোগ হয়েছিল তার।

২০১৪ সাল থেকে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে হ্যালো ডটকমে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে আমিনুর রহমান হৃদয়। সে জানায়, শিশুদের অধিকারের কথা তুলে ধরাই তার প্রতিবেদনে প্রাধান্য পায়।

বৃক্ষমানব আবুল বাজানদারের মত দুরারোগ্য রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ের শিশু রিপনের। তাকে নিয়ে হৃদয়ের করা সংবাদ প্রতিবেদন হ্যালোতে প্রকাশ হওয়ার পর রিপনের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় সরকার।

একইভাবে স্কুলে যাওয়া আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো একটি ভাঙা সাঁকো নিয়ে প্রতিবেদন করে সেখানে কাঠের সেতু স্থাপন করাতে পেরেছিল হৃদয়।

হ্যালোতে কাজ শুরুর পর বিটিভি, এনটিএন বাংলা, ইটিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, ডকুমেন্টারি তৈরিসহ শিশু অধিকার বিষয়ক অনেক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছে নানজিবা খান।

তার ভাষায়, “শিশু হলেও আমরা শুধু শিশুদের অধিকার রক্ষার কাজে সীমাবদ্ধ নই। সামাজিক অসঙ্গতি, বঞ্চনাগুলোও আমাদের কাজের মাধ্যমে উঠে আসছে।”

সংবাদ সম্পাদনা আর প্রকাশের আদ্যোপান্ত জেনে নিচ্ছে শিশু সাংবাদিকরা

খবর কীভাবে সবার কাছে সহজে পাঠযোগ্য করা যায়, প্রশ্ন ছিল শিশু সাংবাদিকদের

কেরানীগঞ্জের শিলা আক্তার মৌ পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। হ্যালোর সঙ্গে যুক্ত থেকে সেও গত একবছর ধরে শিশু সাংবাদিকতা করছে।

শিশুদের সংগ্রহ করা খবর নিয়ে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত ওয়েবসাইট  হ্যালোর যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ। সংবাদ সংগ্রহ থেকে পরিবেশন পর্যন্ত এর সব কাজেই যুক্ত রয়েছে শিশু ও কিশোর সাংবাদিকরা। এ পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি শিশু-কিশোর হ্যালোর সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়েছে।

সংবাদভিত্তিক এই ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রশিক্ষিত শিশু সাংবাদিকরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের তত্ত্বাবধানে মূলধারার গণমাধ্যমেও ভূমিকা রাখছে।

মূল ধারার জন্য অপেক্ষা

শিশু বয়সেই সাংবাদিক! বড় হলে কী হবে?

তুলতুল আর ইভান জানাল, আইন পেশা আর সাংবাদিকতা- দুটোই তাদের পছন্দ। ভবিষ্যতে কী হবে, ভবিষ্যতেই তা ঠিক করবে।

এইচএসসি শেষ করে সিভিল এভিয়েশনে ভর্তি হওয়া নানজিবার বয়স এখন ১৮ হয়নি। তাই এখনও সে শিশু সাংবাদিক। ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা নিয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছে আছে।

“এতোদিন আমরা শুধু মেইল করতাম, আমাদের নিউজ যে এতো ধাপ পেরিয়ে খবর আকারে প্রকাশিত হয় তা জানতাম না। বার্তাকক্ষে এসে সব কিছু জানলাম। আগামীতে ইচ্ছে আছে নিউজ ডেস্কে কাজ করার। কাজটি বেশ জটিল। সবার জন্য সহজ করে লেখা খুব সহজ না,” বলল নানজিবা।

ইভান বলল, “হ্যালোর মাধ্যমে আমরা একটা বড় প্ল্যাটফরম পেয়েছি। আমাদের জন্য আলাদা কাজ করার সুযোগ থাকায় শিশুদের বিষয়ে লেখালেখি করে হাতেখড়ি হয়েছে। আগামীতেও এটা ধরে রাখতে চাই।”

শিশু দিবসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঁচ শিশু সাংবাদিক- আমিনুর রহমান হৃদয়, সাদিক ইভান, নানজিবা খান, নাফিসা ইসলাম তুলতুল আর শিলা আক্তার মৌ 

সংবাদ সংগ্রহ আর প্রতিবেদন তৈরির আদ্যোপান্ত জেনে নিচ্ছে শিশু সাংবাদিকরা

হৃদয়ের পর্যবেক্ষণ হল, সব গণমাধ্যমে শিশুদের সব খবর সেভাবে গুরুত্ব পায় না। সে চায় শিশুদের সংবাদ নিয়মিত মূলপাতায় অগ্রাধিকার পাক।

আর তুলতুল জানাল, হ্যালোর সাংবাদিক হিসেবে নিউজ ডেস্কের কাজের অভিজ্ঞতা তার আগেই হয়েছে। এবার বড়দের বার্তাকক্ষের কাজ দেখে ‘অনেক কিছু’ শিখেছে সে। আগামীতে রিপোর্টিং করার পাশাপাশি নিজেকে ডেস্কের জন্যও প্রস্তুত করার ইচ্ছা রয়েছে।

গেল বছর নভেম্বরে শিশু সাংবাকিতায় নাম লেখানো শিলা আক্তার মৌ বলে, “মাত্রই শুরু করেছি। আত্মবিশ্বাস আস্তে আস্তে বাড়ছে। আজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তাকক্ষ দেখে সাংবাদিকতায় থাকার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হয়েছে।”

শিশু সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিল, ইংরেজি ভাষার সংবাদও যাতে শিশুদের জন্য সহজে বোধগম্য হয়, সে কাজটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কীভাবে করে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হেড অব ইংলিশ নিউজ অরুণ দেবনাথ তাদের বলেন, “সংবাদ যে ভাষাতেই হোক, তা সহজ করে লেখার চেষ্টা সাংবাদিকদের সব সময়ই করতে হয়। আমাদের ইংরেজি সাইটে আমরাও তা করি।  এটা সব সময়ই একটা বড় চ্যালেঞ্জ।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স গাজী নাসির উদ্দিন আহমেদ এই শিশু সাংবাদিকদের বলেন, “প্রেসরিলিজে থাকা তথ্য ছাপানো সাংবাদিকের প্রকৃত কাজ না। এটাকে বলে প্যাসিভ জার্নালিজম। যে সত্যটা কর্তৃপক্ষ গোপন রাখতে চায়, সেটা বের করে এনে প্রকাশ করাই সাংবাদিকের কাজ।”

সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্ভুল থাকার গুরুত্ব তুলে ধরেন বার্তা সম্পাদক মুনীরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, সাংবাদিককে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তার তথ্য নির্ভুল হয়। পাঠককে কখনো ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না।

বিশ্ব শিশু দিবসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিকদের সঙ্গে হ্যালোর শিশু সাংবাদিকরা

সবার সহযোগিতায় শিশু সাংবাদিক

এই শিশু সাংবাদিকদের সবাই জানাল, সাংবাদিকতার শুরু থেকেই পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছে তারা। আর হ্যালোর কাছে পেয়েছে কাজ শেখার, ইচ্ছেমত কাজ করার সুযোগ।

সেই সঙ্গে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর মাঠে-ঘাটে সরকারি, বেসরকারি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতাও তারা পেয়েছে।

তুলতুল বলল, “আমার বাবাই আমাকে সাংবাকিতায় উৎসাহ দিয়েছে, হ্যালোর পরীক্ষা দিতে বাবাই নিয়ে এসেছিল। একবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শিশু সাংবাদিক জেনে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরাও আমাকে খবর সংগ্রহে অনেক সহায়তা করেছে।”

নানজিবা জানায়, কোথাও কোনো বক্তব্যের জন্য কারও সহায়তা চাইলে বেশিরভাগ সময়ই সে পেয়েছে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারও সে নিয়েছে। সংবাদ সংগ্রহ করতে সে গেছে মোহাম্মদপুরের আতশবাজি কারখানার মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। সেখানে এলাকাবাসীরও সহায়তা পেয়েছে।

তবে অনেক সময় কেবল শিশু বলেই যে শিশু সাংবাদিকরা অবহেলার শিকার হয়, সে কথা জানাল হৃদয়।

“আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার সাংবাদিকতাকে ভালো চোখে দেখেননি। পরীক্ষার হলেও আমাকে গালমন্দ শুনতে হয়েছে। তখন খুব হতাশ হয়েছিলাম। পরে ভালো ফলাফল করে দেখিয়েছি। পড়াশুনা ঠিক রেখেই আমাদের কাজ করতে হবে। আমার পরিবার সব সময় আমার সঙ্গে আছে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তা কক্ষে সবার সঙ্গে পরিচিত হতে এই শিশু সাংবাদিকদের সহযোগিতা করেছে ফয়সাল আতিক, নাফিয়া রহমান ও সাজিয়া আফরিন।