ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা, শঙ্কায় স্থানীয়রা

প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ালেও তারা ছড়িয়ে পড়ায় শঙ্কার মধ্যে আছেন কক্সবাজারের বাসিন্দারা।

সুলাইমান নিলয় টেকনাফ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2017, 06:11 PM
Updated : 9 Sept 2017, 07:57 PM

তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের এদেশে অবস্থান স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। এটা হতে দেওয়া যাবে না। আপাতত আশ্রয় দিলেও তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমেই এর সমাধান খুঁজতে হবে।

গত ২৪ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ঘাঁটিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশ অভিমুখে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এরইমধ্যে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ।

রাখাইনে জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। শনিবার টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক ঘুরে কয়েকটি জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারা দেখা যায়।

তারা রোহিঙ্গাদের উখিয়া সদরের পর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন বলে দাবি করা হলেও এর মাঝেই অনেক ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এদিন গাড়িতেও এমন অনেককে কক্সবাজারের দিকে আসতে দেখা গেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, টাকা থাকলে নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় যেতে খুব একটা সমস্যায় পড়ছেন না। যিনি টাকা দিতে পারছেন, তিনি যে কোনো জায়গায় চলে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানবিক কারণে আমরা তাদের ঢুকতে দিয়েছি। কিন্তু তারাতো ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা মনে করছি, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি এরইমধ্যে কক্সবাজার শহরে স্থান নিয়েছে। পার্বত্য তিন জেলা এবং চট্টগ্রাম শহরেও অনেকে চলে গেছে।”

তারা কক্সবাজারে কীভাবে অবস্থান করতে পারছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কক্সবাজারেতো আগে থেকেই রোহিঙ্গারা আছে। তাদেরই আত্মীয়-স্বজন পরিচিতরা এসে এখানে অবস্থান নিচ্ছে। তাই সহজে বোঝাও যাচ্ছে না।

“আমাদের দাবি, এদের সীমান্তের কাছাকাছি টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলায় রাখা হোক।”

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার স্বীকারোক্তি এসেছে অন্য রোহিঙ্গার মুখেও।

রাখাইনের আকিয়াব জেলার চণ্ডম গড়াখালি এলাকার বাসিন্দা সলিমা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মিয়ানমারে সহিংসতায় তার এক আত্মীয় নিহত হওয়ার খবর দেন।

ওই আত্মীয়ের পরিবারের কেউ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিহত ওই ব্যক্তির স্ত্রী কক্সবাজারে চলে গেছেন।

রাখাইনের মংডুর ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে মেরুল্লা পাড়ার বাসিন্দা শরীফ হোসেনকে পাওয়া যায় উখিয়া থেকে টেকনাফের দিকের রাস্তায়। কুতুপালং ক্যাম্প অভিমুখে হাঁটছিলেন তিনি।

কোথায় গিয়েছিলেন এবং এখন কোথায় যাচ্ছেন-প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, উখিয়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিজিবি ফেরত পাঠিয়েছে।

টাকা থাকলে দালালদের দিয়ে গাড়িতে করে কক্সবাজার যেতে পারতেন বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

টেকনাফের লম্বা বিলের বাসিন্দা আবু সওদাগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমরকে বলেন, “বরমাইয়া আর্মি মা-বইনের উফর জোর জুলুম করে। ইতার লাগি ইতারা আইও।

“আরার দেশে আরাই মেলা সমস্যা হই যায়ের। অন্য দেশের মানুষ আইছে। তই-তরকারি কিনতে না ফাইর। বেক্কিন অভাব হই যায়েরগো। ইতারারগো সিদ্ধান্ত করি ইতারা দেশে পাঠাই দেওক। সরকারে সরকারে সিদ্ধান্ত কইরলে ভালা অইবো। ইতারা ছড়াই যায়ের, সমস্যাও ছড়াই যায়ের।”

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিচার্স ইউনিটের (রামরু) প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক  সিআর আবরার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাখাইনে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সেজন্য তাদের ঢুকতে দেওয়া প্রয়োজন ছিল, বাংলাদেশ সেটা দিয়েছে। এখন তাদের নির্দিষ্ট একটা এলাকায় নিয়ে আসাও একটা কাজ। সেখানে যেন তারা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া পায়, সেখানে তাদের নিবন্ধনেরও ব্যবস্থা থাকবে।

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়া ঠেকাতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে বলে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামী কাল পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পিডি আসবেন। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে এদের নিবন্ধন করা হবে। ১৭টি পয়েন্টে এই কাজ করা হবে।”

এরইমধ্যে যারা ছড়িয়ে পড়েছে তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আগামীকাল থেকে আর যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য নজরদারি বাড়াব। আপাতত আমরা যাদের পাব, তাদের নিবন্ধন করে ফেলব।

“বাকীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেলেও তাদের এখানে ফিরিয়ে আনা হবে। তখন নিবন্ধন করা হবে।”

ঢল থামেনি শনিবারও

মিয়ানমার থেকে শরণার্থীদের ঢল এখনও অব্যাহত রয়েছে। শনিবার শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ সদর, হ্নীলার বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অনেকে বাংলাদেশে ঢুকছেন।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জরপাড়া, লম্বা বিল, উলুবনিয়া, উনচিপ্রাং; বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর, জাহাজপুরা, শিলখালী; উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া, রহমতের বিল, ধামনখালী, বাঘেরঘোনা; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী, আমতলী, তমব্রু দিয়ে বাংলাদেশে এখনো রোহিঙ্গারা ঢুকছে।
গত বছর আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালীতে আগে থেকেই একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। সেটার পাশে নতুন কয়েকটি অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে উঠেছে।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের রইক্ষ্যংয়ে দুটি নতুন ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এছাড়াও উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের আশপাশের সব জায়গায় এবং টেকনাফ উপজেলার হ্নীলার লেদা অনিবন্ধিত ক্যাম্পের আশপাশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন।

এর বাইরে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল থেকে শুরু করে রাস্তা ঘাটের পাশেও অনেকে মাথা গোজার ঠাঁই করছেন। অনেককে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে।