আপনের সোনা ফেরত না দিলে ধর্মঘটের হুমকি

আপন জুয়েলার্সের জব্দ করা সোনা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেওয়ার দাবি করে রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2017, 10:10 AM
Updated : 7 June 2017, 02:48 PM

বুধবার বায়তুল মোকাররমে সমিতির কার্যালয়ে দুই ঘণ্টা বৈঠকের পর সংগঠনের সহ-সভাপতি এনামুল হক খান দোলন সাংবাদিকদের সামনে এই ঘোষণা দেন।

আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ ফেরত দেওয়া এবং সোনা আমদানির নীতিমালা করার পাশাপাশি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খানের অপসারণও দাবি করেন তিনি।

দোলন বলেন, “জামায়াত-বিএনপির একটি চক্রান্তে একটি চক্র সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্পকে ধ্বংসের জন্য সেই চক্র উঠে পড়ে লেগেছে, তারা নীল নকশা করছে। তাদের স্বার্থ রক্ষায় শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালক মইনুল খান কাজ করছেন।

“মইনুল খান বলেছেন, এই সোনা সব অপকর্মের অক্সিজেন। আপনার স্ত্রী, মায়ের গায়ে যে সোনার অলঙ্কার সেটার ব্যাখ্যা আপনার দিতে হবে। সরকারের কাছে তার অপসারণ দাবি করছি।”

বনানীর হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের পরিবারের মালিকানাধীন আপন জুয়েলার্সের ১৫ দশমিক ৩ মণ সোনা এবং ৭ হাজার ৩৬৯টি হীরার অলঙ্কার জব্দ করে গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠান শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।

শুল্ক ফাঁকি রোধে দায়িত্বরত এই সংস্থা বলছে, মজুদ এসব সোনা-গহনার বৈধতার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি আপন জুয়েলার্স।

এছাড়া তাদের কাছ থেকে উদ্ধার স্বর্ণালঙ্কারের সঙ্গে তারা ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স বিবরণীতে যে পরিমাণের কথা বলেছেন তাতে বিস্তর ফারাক রয়েছে জানিয়ে সংস্থার মহাপরিচালক মইনুল খান বলেছেন, এ বিষয়েও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বর্ণের খনি না থাকা বাংলাদেশে প্রায় এক দশক মূল্যবান এই ধাতু আমদানি ছাড়াই ব্যবসা চালিয়ে আসা সোনা ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নেতা এনামুল হক দোলন বলেন, “আপন জুয়েলার্স যেভাবে ব্যবসা করেছে, স্বর্ণ প্রাপ্তি সেরকম সারা দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা একইভাবে ব্যবসা করেন। আমি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলাম। এখন উনি (মইনুল খান) কী করবেন? কাল থেকে অভিযান চালাবেন? কিন্তু অভিযানতো আমরা চালাতে দেব না।”

জুয়েলার্স সমিতির এই নেতা বলেন, “এদেশে মইনুল সাহেবের উপরেও মইনুল খান আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ আশা করছি। আমরা তার কাছে ন্যায়বিচার পাব। এই শিল্পকে আমরা ধ্বংস হতে দেব না।”

বনানীর ধর্ষণকাণ্ডে ছেলের নাম আসার পর তার পক্ষ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দেন সাফাতের বাবা দিলদার আহমেদ, যিনি আপন জুয়েলার্সের মালিক তিন ভাইয়ের একজন।

জন্মদিনের পার্টির কথা বলে গত ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে সাফাত ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। তাদের সহযোগিতার জন্য সাফাতের আরেক বন্ধু হোটেল ব্যবসায়ীর ছেলে সাদমান সাকিফ এবং সাফাতের দেহরক্ষী ও গাড়িচালককে মামলায় আসামি করা হয়।

ফাইল ছবি

বিষয়টি জানাজানির পর তুমুল আলোচনার মধ্যে ছেলের পক্ষ নিয়ে দিলদার বলেন, “ওই রাতে কিছু হয়ে থাকলে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে হয়েছে।”

তার এই বক্তব্যের পর ‘ধর্ষকদের’ গ্রেপ্তারের পাশাপাশি আপন জুয়েলার্স বর্জনের ডাক এবং তাদের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ নিয়ে ফেইসবুকে সরব হন অনেকে।

এই প্রেক্ষাপটে আপন জুয়েলার্সের সোনার উৎস নিয়ে তদন্তে নামেন শুল্ক গোয়েন্দারা। আপনের মালিক দিলদার এবং তার দুই ভাই গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদ দুই দফায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে গিয়ে শুনানিতে অংশ নেন। কিন্তু তারা এসব সোনা ও হীরা আমদানি বা মালিকানার বিষয়ে কোন বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এরপর তাদের সোনা জব্দ করা হয়।

তবে জুয়েলার্স সমিতির নেতা দোলন বলছেন ভিন্ন কথা: “এটা তো কোনো মগের মুল্লুক না। এটা কি কোনো দিন মানা যায়? যেই কাগজ আমরা জমা দিয়েছি সেটা উনি মানেন না। একটা মানুষ যদি বৈধভাবে বিদেশ গিয়ে ট্যাক্স দিয়ে সোনা আনেন আর আমি যদি সেটা কিনি তাতে অপরাধটা কী?

“আমি বড়লোক হলে তার (মইনুল খান) সমস্যাটা কী? সম্পূর্ণ প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বনানীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।”

এখন এসব স্বর্ণালঙ্কার আপন জুয়েলার্সকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “যে অন্যায়ভাবে আপন জুয়েলার্সের গহনা আটক করা হয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো সসম্মানে ফেরত দিতে হবে।

“আগামী রোববার দেশের সমস্ত জুয়েলারি দোকান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করছি। যতদিন পর্যন্ত স্বর্ণ নীতিমালা না দেবেন, যতদিন পর্যন্ত আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারব ততদিন পর্যন্ত আমরা এই দেশে জুয়েলারি ব্যবসা করব না।”

ফাইল ছবি

দোকান বন্ধের পাশাপাশি সোমবার কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পদযাত্রা করে সচিবালয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীকে স্মারক লিপি দেওয়ার কর্মসূচি দেন দোলন। এরপর বৃহস্পতিবার সারা দেশ থেকে জুয়েলারি মালিক, ‘পোদ্দার’ ও কারিগরদের নিয়ে মহাসমাবেশের ডাক দেন দোলন।

তাদের এই কর্মসূচির বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুয়েলার্স সমিতির দাবির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা আশা করছি, আইনের মাধ্যমেই আমরা ন্যায়বিচার পাব।”

শুল্ক গোয়েন্দাদের কারণে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বলে দোলন বললেও মইনুল খান বলছেন, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হবে না।

সম্প্রতি তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আপন জুয়েলার্সে শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়েছে। আটক সোনার বিষয়ে বৈধ কাগজপত্র চাইলেও আপন জুয়েলার্সে কোন বৈধ ও বিশ্বাসযোগ্য কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

“সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোথাও অভিযান চালানো হবে না। তাই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ভীত হবার কিছু নেই।”

সোনা আমদানি নীতিমালা সহজ করতে তাদের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

সংবাদ সম্মেলনে জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকারসহ সংগঠনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।