কয়েক দশকজুড়ে দর্শকের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত কবরীর বইটি প্রকাশ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর পাবলিশিং লিমিটেড (বিপিএল)।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বিপিএলের স্টলে মেলার শেষ বেলা কাটান কবরী, আর যথারীতি তাকে ঘিরে ছিল ভিড়।
প্রিয় অভিনেত্রীর অবস্থানের খবর পেয়ে ছুটে আসেন অনেকে। বই কিনে লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার সঙ্গে ছবি তোলার আবদারও মেটাতে হয় কবরীকে।
এর মধ্যে ছিলেন নওগাঁ থেকে মেলায় আসা সাবেক স্কুলশিক্ষক, লেখক খসরু চৌধুরী আর গৃহিণী রাশেদা বেগম।
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার একটি বই কিনে তাতে মেয়ে ত্রপা মজুমদারের উদ্দেশ্যে কিছু লিখে দিতে বলেন তিনি।
বই কেনার ফাঁকে অভিনেত্রী কবরীর সঙ্গে কথায়ও মেতে ওঠেন রামেন্দু মজুমদার।
বনানী বিদ্যানিকেতনের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক রমেন রায় বলেন, “সিনেমা হলে গিয়ে তার কত ছবি দেখেছি! আজ তার সাথে দুটো কথা বলার সুযোগ হল। আমি ভাবতেই পারছি না।”
এই প্রজন্মের কেউ কবরীকে রুপালি পর্দার নায়িকা হিসেবে না দেখলেও তাদের অনেকে এসেছিলেন বইটি কিনতে। এদের কারও বাবার কারও বা মায়ের জন্য এই বই কেনা।
বইটি নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউটের ইনচার্জ রিফাত মুনমুন।
লেখিকার অটোগ্রাফ নিয়ে তিনি বলেন, “এ এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত, আমাদের মতো সাধারণ দর্শকের সঙ্গে কত সহজে মিশে গেলেন!”
রিফাতের সঙ্গে ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হংকংয়ের নাগরিক অ্যাং চেন। তিনি বলেন, বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকার কথা তিনি দেশে ফিরে বন্ধুদের বলবেন।
কবরীর ‘সুতরাং’ ও ‘রংবাজ’ চলচ্চিত্র দেখার কথাও জানান এই বিদেশি।
নিউ জিল্যান্ড প্রবাসী শিক্ষকের জন্য বইটি কিনতে মেলায় আসেন একজন। তিনি বলেন, তার শিক্ষক অটোগ্রাফসহ বইটি পাঠাতে অনুরোধ করেছেন।
৩০ বছর ধরে চিকিৎসা পেশায় থাকা একজন বললেন, ছাত্রজীবনে কবরীর অনেক চলচ্চিত্র তিন-চার বার করে দেখেছেন। এখন সেই স্বপ্নের সেই নায়িকার বইটি কিনলেন তিনি।
‘স্মৃতিটুকু থাক’ সংগ্রহে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তমা ও স্বর্ণা, ঢাকাই সিনেমার কর্মী মনিরুজ্জামান।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে। তখনও অটোগ্রাফ শিকারির দল ঢুঁ মারেন বিপিএলের স্টলে।
‘বাবা-মার বিয়ে বার্ষিকীতে উপহার দেব’, কারও ক্ষেত্রে জন্মদিনের উপহার-এ ধরনের নানা অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে বইটি দেওয়ার কথা জানিয়ে সেভাবে বইয়ে কবরীর অটোগ্রাফ নেওয়া চলতে থাকে মেলার আলো নেভা পর্যন্ত।
বিপিএলের স্টলে কবরীর এই আড্ডায় ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীও। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন আর্টস ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান।
কবি নুরুল হুদা তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় মাতিয়ে রাখেন আড্ডা। তারই ফাঁকে ভক্ত-অনুরাগীদের আবদার মিটিয়ে চলেন কবরী।
এরইমধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “সাদা চোখে অনেক বলবে রফিক, শফিক, জব্বারদের কথা তো বইয়ে লেখা নাই।কিন্তু আমার লেখনীতেই আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। তারা আছেন আমাদের অন্তরে, আছেন ধমনীতে। আমাদের মনেপ্রাণে তারা চিরজীবিত।”
এই অভিনেত্রী জানান, অনেক আগে থেকেই পরিবার আর ভক্ত-অনুরাগীদের অনুরোধ ছিল আত্মজীবনী প্রকাশের। কিন্তু মন সায় দেয়নি। একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম প্রকাশিত হলেও তাতে ‘মন ভরেনি’।
“আমার নিজের অনুভূতি, ইমোশন, রাগ, দুঃখ আর কষ্টগুলো আমি নিজে যত আউটবার্স্ট করতে পারব, অন্যরা তো আমার মেজাজ বুঝবে না। আমি কিন্তু খুবই মুডি। সময়-কাল-পাত্র ভেদে আমি কখনও খুব সাধারণ, একেক সময় অসাধারণ হয়ে যাই।”
কবরী বলেন, “নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করি, নিজের সাথে নিজেই কম্পিটিশন করি। নিজের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড় করাই। এমনটা তো আমি না করলেও পারতাম। আবার ভাবি, আমার এমনটি করা উচিত।”
আত্মজীবনী প্রকাশে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
কবরী বলেন, “দর্শকের কাছাকাছি বরাবরই ছিলাম। এবার নতুন আনন্দ আর এক নতুন পালক যোগ হল। কতটুকু সফল আর কতটুকু বিফল হলাম, তা আমার মাথায় আসছে না। কেবলই মনে হচ্ছে আরেকটু ভালো হতে পারত। আরেকটু সময় যদি পেতাম…
“যারা শিল্প সৃষ্টি করে, যাদের মনের ভেতরে কাজের তাগিদ থাকে, নিজের জীবনের সব টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে জড়ো করে পরে মনে হল-আহারে সেটা কেন লিখলাম না? আফসোস কিন্তু থেকে যায়।”
দর্শকরা তার সিনেমার কথা মনে রাখলে এই বইয়ের মধ্যে তাকে নতুন করে খুঁজে পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন কবরী।
বিপিএল স্টল থেকে বেরিয়ে রাইটার্স ক্লাবের স্টলে ঢু মারেন কবরী; তখন তাকে ঘিরে চলে কবি-লেখকদের হুল্লোড়।
রাইটার্স ক্লাবের সভাপতি কবি নূরুল হুদাকে দেখিয়ে রসিকতা করে একজন বলে ওঠেন, “আমরা এখন নতুন একজন পেলাম; কবরীই হবেন আমাদের পরবর্তী সভাপতি।”
মেলা থেকে বের হওয়ার সময় টিএসসি মোড়ে কবি নির্মলেন্দু গুণকে দেখে থামেন কবরী, কথা বলেন তার সঙ্গে; কবি আর নতুন লেখককে ঘিরে তখন জটলা, সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক।
অভিনেত্রী কবরীর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের গ্রন্থটির ভূমিকা কবি নির্মলেন্দু গুণই লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, “স্মৃতিটুকু থাক- এর পাণ্ডুলিপি পাঠ করে আমার মনে হলো, আমি কোনো কবির রচিত আত্মজৈবনিক গদ্য পাঠ করছি।”
“চিত্রনায়িকা কবরীর এই রচনা শুধু তার জীবনই নয়। পাকিস্তানি ছায়াছবির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী বাংলা ছায়াছবি এবং পূর্ব বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক মুক্তি সংগ্রামের এক বিশ্বস্ত দলিলও বটে,” লিখেছেন তিনি।