মগবাজার ফ্লাইওভার: স্বস্তির বদলে ভোগান্তির শঙ্কা

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের উড়ালসড়কের পিলার উঠতে দেখে যানজটমুক্তির আশা জাগলেও আলোচিত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

মাসুম বিল্লাহফয়সাল আতিক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2016, 03:26 PM
Updated : 22 Jan 2016, 04:24 PM

বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ের কথা মাথায় রেখে বিদেশি প্রকৌশলীর করা নকশায় নির্মাণাধীন ৮ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়াল সড়কে ওঠা-নামার র‌্যাম্প জটিলতার পাশাপাশি আরও কিছু ত্রুটির কথা বলছেন তারা।

এসব ত্রুটি রয়ে যাওয়ার জন্য গেল দশকের প্রথমার্ধে করা নকশা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়ার আগে দেশীয় পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ, স্বতন্ত্র কোনো বিশেষজ্ঞকে দিয়ে যাচাই ও গণশুনানি না করাকে চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক।

উড়ালসড়কের নকশার ত্রুটি তুলে ধরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতো দীর্ঘ একটি উড়ালসড়কে পর্যাপ্ত রাইট টার্নের ব্যবস্থা না রাখায় তা যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে না। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার যে সুবিধাটুকু ফ্লাইওভার থেকে পাওয়ার কথা ছিল তাও পাওয়া যাবে না।

“এছাড়া ফ্লাইওভারের মৌচাক এলাকার একটি স্থানে সিগনাল পদ্ধতি রাখা হয়েছে, যা উড়ালসড়কের উপরেই যানজট সৃষ্টির কারণ হবে।”

চার লেনবিশিষ্ট এ উড়ালসড়কে উঠা-নামার জন্য তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজার, রমনা (হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তা), বাংলামোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও শান্তিনগর মোড়ে লুপ বা র‌্যাম্প রাখা হয়েছে। 

নির্মাণ শুরুর তিন বছরের মাথায় ফ্লাইওভারটি ভৌত রূপ লাভের পর দেখা যাচ্ছে, এর উঠার পথ নামার পথের চেয়ে তুলনামূলক খাড়া। অথচ উপরে উঠার জন্য ঢালু পথ ও নিচে নামার জন্য খাড়া পথ যানবাহনের জন্য উপযোগী বলে ধরা হয়।

এই ফ্লাইওভারের নকশা করার ক্ষেত্রে বিদেশে বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রাখায় উঠা-নামার লুপে এই বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক শামসুল হক।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক ফিটনেসবিহীন ও ওভারলোডেড বাস-ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন রাস্তায় চলছে। মালবাহী গাড়িগুলো খাড়া লুপ দিয়ে উঠার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি থাকবে।

কুড়িল ফ্লাইওভার ও বনানী-জিয়া কলোনি ফ্লাইওভারের নকশাকার শামসুল হক বলেন, সাধারণত সিগনাল ও যানজটের ঝামেলা এড়িয়ে ডানদিকের রাস্তায় যাওয়ার সুবিধা করতেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। মহাখালী ও খিলগাঁও ফ্লাইওভার এর উদাহরণ।

“কিন্তু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকায় ডানে যাওয়া বা রাইট টার্নের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

“রাইট টার্ন না থাকলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই স্থাপনা ব্যবহার করা আর ভূমির উপরে তৈরি রাস্তার মধ্যে পার্থক্যটা থাকল কী? উল্টো ফ্লাইওভারের কলামগুলোর কারণে রাস্তার জায়গা নষ্ট হলো।”

নকশায় ত্রুটির বিষয়গুলো কিভাবে ধরা পড়ল সে বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “নির্মাণ কাজের মাঝামাঝি সময়ে এলজিইডির লোকজন আমাদের কাছে এসেছিলেন ভিন্ন একটি সমস্যা নিয়ে। ফ্লাইওভারের ডেক (মেঝে) স্থাপনে হিসাবের গরমিল নিয়ে তারা এসেছিলেন। আমরা সেটার সমাধান করতে পেরেছি। নকশার বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে যে অভিযোগ আসছিল তারও সত্যতা পাওয়া যায় তখন।”

প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ যে পর্যায়ে এসেছে এখন এসব ত্রুটি থেকে উত্তরণ প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।

“যে ত্রুটিগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে এগুলো সমাধানের এখন আর সুযোগ নেই। তবে এমন ভুল যাতে ভবিষ্যতে না হয় এর থেকে সেই শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।”

এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও নীতি-নির্ধারকদের দুষছেন ঢাকা মহানগরীর কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়নের অন্যতম বিশেষজ্ঞ শামসুল হক।

“সাধারণত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এলজিইডি শহরের বাইরের কাজগুলো করে থাকে। এটা ঢাকা শহরের ভেতরের কাজ হলেও এলজিইডির তত্ত্বাবধায়নে হচ্ছে।

“শহর এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের অভিজ্ঞতা এই বিভাগের প্রকৌশলীদের তেমন নেই। তার ওপরে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের সহযোগিতায় তৈরি এই নকশা বাস্তাবায়নে যাওয়ার আগে দেশীয় প্রকৌশলীদের সঙ্গেও কোনো পরামর্শ করা হয়নি। তাই সমস্যাগুলো কারো চোখেও পড়েনি।”

ত্রুটি নিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, “শহরের ভিতরে এতো বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়ার আগে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। যারা এর বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত তাদের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃজনক ও নিন্দনীয়।

“এমনিতেই বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি আর কয়েক বছর ধরে নির্মাণযজ্ঞের কারণে নগরবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। তার মধ্যে এ ধরনের ত্রুটির কথা শোনা গেলে তা নিন্দাযোগ্য।”

এসব বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) নাজমুল আলমের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গেছেন।

মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পেরে আগারগাঁওয়ে এলজিইডি ভবনে তার কার্যালয়ে যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি দল। সেখানে মুখোমুখি হওয়ার পর ‘দু/চারদিন’ পরে এ বিষয়ে কথা বলার আশ্বাস দিয়ে চলে যান নাজমুল।

তিনদিনের মাথায় আবারও যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব বিষয়ে কথা বলতে ‘বিরক্তি’ প্রকাশ করেন।

এরপর মোবাইলে কয়েকবারের চেষ্টার পর কল রিসিভ করলেও কোনো কারণ ছাড়াই ক্ষেপে ওঠেন প্রকল্প পরিচালক।

“আরে বাবা আমি এখন মগবাজারে, ফ্লাইওভার নির্মাণের স্পটে। এসব নিয়ে আর কথা বলার কী আছে? পত্র-পত্রিকায় তো লেখালেখি হচ্ছেই,” বলে সংযোগ কেটে দেন তিনি।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

তবে ঠিকাদার ও তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর এখন ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান ‘সিমপ্লেক্স নাভানা জেভি’ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড উড়ালসড়কটির নির্মাণ কাজ করছে।

উড়ালসড়কের সাতরাস্তা থেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত অংশ গত ডিসেম্বরেই চালু করা হবে বলে কয়েক মাস আগে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন প্রকল্প পরিচালক নাজমুল আলম।

সেই ডিসেম্বর পেরিয়ে এখন নতুন বছরের প্রথম মাসও শেষ হওয়ার পথে। হাতিরঝিল এলাকায় এখনও কয়েকটি পিলারে কেবল গার্ডার বসানো আছে।

যে গতিতে কাজ চলছে এসব গার্ডারে ঢালা বসানোসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজ করতে আরও কতোদিন লাগবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাংলামোটর থেকে মগবাজার এবং মগবাজার থেকে মৌচাক, মালিবাগ ও শান্তিনগর এলাকায় প্রকল্পের কাজ চলছে।

তবে রাজারবাগ থেকে মৌচাক হয়ে রামপুরার দিকে যাওয়া ফ্লাইওভারের অংশটির কাজ চলছে ধীর গতিতে। কয়েক স্থানে ফ্লাইওভারের পিলার ৬/৭ মাস ধরে অর্ধেক নির্মাণ অবস্থায় পড়ে থাকলেও সেখানে নতুন করে হাত পড়েনি।

নির্মাণ শুরুর তিন বছর পরেও তমা কনস্ট্রাকশনের আওতাধীন এলাকায় এখনও পাইলিংয়ের কাজে ব্যবহৃত ভারি ক্রেনগুলো দাঁড়িয়ে আছে।

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মৌচাক, মালিবাগ ও শান্তিনগরে নির্মাণকাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওই এলাকায় রাস্তায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ার ফলে যানবাহন চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। স্থানে স্থানে কাদা হওয়ার পাশাপাশি ফুটপাতগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পায়ে হেঁটে চলাচলও কষ্টসাধ্য।