“এতে করে ভুক্তভোগীর পরিবার সঠিক বিচার পাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে,” বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
Published : 08 Sep 2024, 11:19 PM
ক্ষমতার পালাবদলের পর গত এক মাসে বিগত সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় পৌনে তিনশ মামলা হয়েছে আদালতে এবং দেশের বিভিন্ন থানায়।
এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ২৬ হাজারের বেশি মানুষকে; অজ্ঞাতপরিচয় আসামি রয়েছে দেড় লাখের ওপরে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়ে হত্যা এবং নির্যাতন চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে এসব মামলায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেই ১৩০টির বেশি মামলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার মধ্যে ১১৯টিতেই হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি ১১টি মামলা হয়েছে হত্যাচেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগে।
গণআসামি করে দায়ের করা এসব মামলা বিচারের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, জুলাই-অগাস্টের গণ আন্দোলনে হতাহতের বিচার চেয়ে দেশজুড়ে যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলোর ধরণ যেন আওয়ামী লীগ আমলের ‘গায়েবি’ মামলার মতই। এতে করে ভুক্তভোগীর পরিবার সঠিক বিচার পাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিহতের পরিবার আরেকটা লেভেলে ভুক্তভোগী হচ্ছেন, যেটি তারা হয়ত বুঝতেই পারছেন না।
“আওয়ামী সরকারের আমলে বিরোধীদের দমন করতে যে প্রক্রিয়ায় মামলা হয়েছিল, এখনও মামলাগুলো একই রকম ফরম্যাটে হচ্ছে।”
এ ধরনের ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ বলে বর্ণনা করেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
গণ আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে এবং হচ্ছে, সেগুলোর অভিযোগের ভাষা প্রায় একই।
এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি), সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, এমনকি সাংবাদিকদেরও।
বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অগাস্টজুড়ে শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী-এমপি ও দলটির নেতাকর্মীদের নামে শনিবার পর্যন্ত ২৬৮টি মামলা হয়েছে।
এসব মামলায় ২৬ হাজার ২৬৪ জনের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে। আর অজ্ঞাতনামা অন্তত ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, “গণহারে এমন মামলার কারণে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তদন্ত কর্মকর্তার সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে আসল আসামিদের খুঁজে পাবেন না। তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতেও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে ১৬ জুলাই থেকে ১১ অগাস্টের মধ্যে সহিংসতায় বাংলাদেশে অন্তত ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়-ওএইচসিএইচআর।
আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে ১৫ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬২২ জন, আহত হয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি মানুষ।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর ৮ আগস্ট নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
আন্দোলন ঘিরে জুলাই-অগাস্ট মাসে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তাকে ‘জুলাই গণহত্যা’ বলছেন সরকারের উপদেষ্টারা। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য ১৩ অগাস্ট থেকে মামলা দায়ের শুরু হয়।
অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করলে যে ভাষ্য পাওয়া যায় তা মোটামুটি এরকম–আন্দোলনের সময় নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা হুকুমদাতা, অর্থদাতা এবং পরিকল্পনাকারী।
যাত্রাবাড়ীর হত্যা মামলায় আসামি সব লালমনিরহাটের
গত ৫ অগাস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মিরাজুল ইসলাম (২১) নামে এক তরুণ নিহতের ঘটনায় ২৪ অগাস্ট একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তার বাবা মো. আব্দুস ছালাম।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল ঢাকা হলেও মামলার আসামি করা হয় বাদীর নিজ এলাকা লালমনিরহাট জেলার ৩৬ জনকে। এতে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২০০-৩০০ জনকে।
নাম নিশ্চিত করা ৩৬ আসামির মধ্যে রয়েছেন লালমনিরহাট-১ এর সাবেক সংসদ সদস্য মো. মোতাহের হোসেন, লালমনিরহাট-২ এর সাবেক সংসদ সদস্য মো. নুরুজ্জামান আহমেদ ও লালমনিরহাট-৩ এর সাবেক সংসদ সদস্য মো. মতিয়ার রহমান।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী, আসামিদের মধ্যে শুধু মোতাহের হোসেনের বর্তমান ঠিকানা ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায়।
এজাহারে বলা হয়েছে, গত ৫ অগাস্ট সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভে যোগ দেন মিরাজুল ইসলাম। তখন যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র, লোহার রড, বাঁশ, হকিস্টিকসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীরা মিরাজুলকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ অগাস্ট তিনি মারা যান।
এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী মো. আব্দুস ছালামের মোবাইল ফোনে বারবার ফোন করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মো. মাহবুব হোসেন বলেন, “এ মামলায় এখনও কেউ গ্রেপ্তার নেই। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানি না, আমাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
“মামলায় নামের আসামির পাশাপাশি অজ্ঞাতও অনেকে আছেন। তদন্ত চলছে, আমরা ঘটনার সঙ্গে প্রকৃত জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কানাডায় থেকেও হত্যার আসামি সাকিব
গত ৫ অগাস্ট ঢাকার আদাবরে গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানকে, যিনি ঘটনার সময় কানাডাতে টি-টোয়েন্টি লীগে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন।
২২ অগাস্ট রুবেলের বাবা রফিকুল ইসলাম মামলা করার দিনটিতেও সাকিব ছিলেন পাকিস্তানে, খেলছিলেন টেস্ট সিরিজ।
ওই একই মামলায় আসামি করা হয়েছে বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকেও। এ ছাড়া মামলার প্রধান আসামি শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৫৬ আসামির নাম রয়েছে তালিকায়।
আলোচিত সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও নায়ক ফেরদৌস আহমেদকেও এ মামলার আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগ, কৃষক লীগ ও মৎসজীবী লীগের নাম রয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে এজাহার দাখিল করেছেন বাদী।
বাদী রফিকুল এজাহারে বলেছেন, গত ৫ অগাস্ট রুবেল আদাবরের রিংরোডে প্রতিবাদী মিছিলে অংশ নেয়। এ সময় আসামিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ, প্ররোচণা, সাহয্য, সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ মদদে এদেরই কেউ মিছিলে গুলি ছোড়ে। এতে বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ আহত রুবেলকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসারত অবস্থায় ৭ অগাস্ট মারা যায়।
এজাহারে যেসব আসামির আদেশ-নির্দেশে ছাত্র-জনতাকে ‘দেখা মাত্র গুলি’ করে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে, যেখানে সাকিবের দায় রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এজাহারে দেওয়া রফিকুলের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে তাকে পাওয়া গেলেও তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
এ ধরনের মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “কেউ কোনো ফৌজদারি অভিযোগ জমা দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ তা নিতে বাধ্য। আদালতের নির্দেশ থাকলেও পুলিশ অভিযোগ নিতে বাধ্য।
“কিছু ক্ষেত্রে যদি পুলিশ মনে করে অভিযোগের সারবস্তু ঠিক নেই, তাহলে প্রথমে সেটিকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে লিপিবদ্ধ করে তদন্ত শুরু করতে পারে। এটি আইনে বলা আছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ এমনটি করবে না।”
এসব মামলার তদন্তই ঠিকমত হবে না বলে মন্তব্য করে নুরুল হুদা বলেন, “মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণ নির্দিষ্ট হতে হবে। অভিযুক্তের দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে উল্লেখ করে চার্জশিট দাখিল করতে হয়। গণহারে আসামি করার পর যদি তাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা না যায়, তাহলে মামলাগুলো দুর্বল হবে।”
মামলার নামে ‘নাম বাণিজ্য’
ঢালাওভাবে যেসব মামলা হচ্ছে, সেখানে আসামিদের নাম কীভাবে ঢুকে যাচ্ছে বা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে; এমন প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “রংপুর থেকে এক মা এসে বলছেন তার ছেলেকে নিউ মার্কেট এলাকায় গুলি করে মারা হয়েছে। তিনি হয়তো ভিডিও ফুটেজে নিজের ছেলেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছেন, কিন্তু কে গুলি করেছে তিনি কাউকে চেনেন না। কিন্তু মামলায় ৫০০ জনের নাম দেওয়া হচ্ছে, এই নামগুলো তিনি কোথা থেকে পেলেন?”
তার ভাষায়, “একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে, যারা এসব মামলার নাম নিয়ে বাণিজ্য করছেন। যথাযথ একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব করছেন।
“অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও বাণিজ্য করছে, নিজেদের নাম বাদ দিয়ে নিজেরাই এফআইআর পাল্টে ফেলছে। কিন্তু এফআইআর পাল্টানোর ক্ষমতা কারও নেই। বাদী যদি ভুলও দেন সেটাকেই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে এফআইআর পাল্টে ফেলার কথাও শুনতে পাচ্ছি। পুলিশ তার পুরনো আচরণ থেকে বের হতে পারছে না।”
জ্যোতির্ময় বলেন, “গণহারে এমন মামলার কারণে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধরে নিচ্ছি পরিবর্তীত ব্যবস্থায় পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে মামলাগুলোর তদন্ত করবে। মূল জড়িতদের শনাক্ত করতে পুলিশ যদি তদন্তের চেষ্টা করেও, তথ্যগুলো খুঁজে বের করতে অনেক সময়ক্ষেপণ হবে। কে ছিল খুঁজতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আসল আসামিদের খুঁজে পাবে না। তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।”
এই আইনজীবী ভাষ্য, “এসব মামলায় অনেক পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হচ্ছে, কারণ পুলিশের নাম সহজেই বের করা সম্ভব। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় বিজিবির কোনো সদস্যের নাম কেন আসেনি? তারা কি গুলি করেননি? তারা গুলি করে থাকলে তাদের নামে কেন মামলা হবে না?”
যথাযথ প্রক্রিয়ায় মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কী করা যেত– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “মামলা করার আগে একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যেত। সরকারের তরফ থেকে একটা টিম গঠন করে দেওয়া যেত, তারা বিষয়গুলো তদারকি করতেন।
“আবার বলা হচ্ছিল মামলাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ (আইসিটি) ট্রাইব্যুনালে হবে। এ ক্ষেত্রে মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালেই করা যেত। এমন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তাদের এ নিয়ে কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না।”
আইনজীবী জ্যোতির্ময়ের মতে, এখনও সময় আছে, অনেক মামলা বাকি। নিহতদের সঠিক সংখ্যা এখনও শনাক্ত হয়নি। দ্রুততার সঙ্গে এই সংখ্যা নির্ধারণ করে সামনের দিকে এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দিকটি দেখতে চান তিনি।
অসঙ্গতিতে ‘গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে’ মামলা
গত ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, আন্দোলনে যে প্রাণহানি হয়েছে, সে বিষয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রুজু হচ্ছে বহু মামলা।
“কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনায় ঢালাওভাবে মামলা ও আসামি করে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলাগুলোতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে ও মনগড়া এজাহার দেওয়া হয়েছে বলেও জানা যায়। নানা অসঙ্গতিতে মামলাগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।”
সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে মানবাধিকার কমিশন বলেছে, যাত্রাবাড়ীতে ইমরান হোসেন নামের এক তরুণকে হত্যার মামলায় প্রথিতযশা আইনজীবী ও স্বনামধন্য সাংবাদিকসহ ২৯৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের নন-অপারেশনাল ইউনিটে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীকে আসামি করে জুনের মৃত্যুকে অগাস্টের আন্দোলনে নিহত দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে গুলি ছুড়ে’ হয়েছেন অভিযুক্ত।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একই ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন এজাহার ও ভিন্ন ভিন্ন আসামির নাম দিয়ে মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের নির্বিচারে আসামি করা মামলাকে ‘দুর্বল করে’ এবং তা প্রকৃত অপরাধী শনাক্তকরণে বাধা দেয়।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “নির্বিচারে ও ঢালাওভাবে আসামি করে মামলা দায়ের কোনোভাবে কাম্য নয়। এটি অনৈতিক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মামলাগুলো বস্তুনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃত ঘটনা নিরূপণ করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানির হাত থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সকল অংশীজনের দায়িত্ব।
“তথ্যগত অসামঞ্জস্যতা ও অসংগতি মামলাকে দুর্বল করে ফেলে। যথাযথ যাচাই-বাছাই করে মামলা করা না হলে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যেতে পারে এবং তা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।”
গ্রেপ্তাররা দফায় দফায় রিমান্ডে
বিভিন্ন মামলায় এখন পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইজিপি, সরকারি কর্মকর্তাসহ অন্তত ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারও কারও জায়গা হয়েছে কারাগারে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১৩ অগাস্ট প্রথম গ্রেপ্তার হন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। পৃথক চারটি হত্যা মামলায় তিন দফায় পুলিশ তাদের ২৫ দিনের রিমান্ডে পায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এখনও চলছে।
১৪ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ও জুনাইদ আহমেদ পলক তিন দফায় মোট ২০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। ১৯ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি আট দিনের ও সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় ১৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
২০ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাবেক সংসদ সদস্য আহমদ হোসেনকে ১৪ দিন, ২২ অগাস্ট গ্রেপ্তার বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে ১১ দিন, ২৩ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজকে ১০ দিনের রিমান্ডে দেয় আদালত।
২৬ অগাস্ট গ্রেপ্তার জাসদ সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে ১২ দিন, ২৮ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
২৫ অগাস্ট গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপকে ১০ দিন, ২৪ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খানকে ৯ দিন, ২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিমকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে দিয়েছে আদালত। সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রেপ্তার সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানকে সাত দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।
কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৬ অগাস্ট গ্রেপ্তার ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে তিন দফায় ২৩ দিন, ২০ অগাস্ট গ্রেপ্তার নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ সোহায়েল দুই দফায় ১১ দিন রিমান্ডে রয়েছেন।
৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হককে সাত দিন এবং চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে আট দিন এবং ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগারওয়ালাকে তিন দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।
রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে গত ২১ অগাস্ট গ্রেপ্তার সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপা দম্পতিকে ৯ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।
আসামি ৯৪ পুলিশ
আন্দোলনের সময় হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া ও নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ৯৪ জন পুলিশ সদস্যের নামে বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। সম্প্রতি তাদের কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।
গত ১৩ অগাস্ট থেকে দায়ের করা আড়াই শতাধিক মামলাতেই পুলিশ সদস্যদের নাম এসেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯১টি মামলা করা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায়।
পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮টি মামলা হয়েছে ডিএমপি ডিবির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের নামে। এর পরের অবস্থানে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের নামে মামলা হয়েছে ৩৬টি।
সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নামে ৩৩টি, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ২৭টি, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলামের নামে ১১টি, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসাইনের নামে আটটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ হত্যায় মামলা শুধু এনায়েতপুরে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতনে রূপ নেওয়া আন্দোলনে সহিংসতায় ৪৪ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে কনস্টেবল পদমর্যাদারই ২১ জন বলে তথ্য দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
নিহত পুলিশ সদস্যদের তালিকা অনুযায়ী, গত ২১ জুলাই থেকে ১৪ অগাস্টের মধ্যে এই পুলিশ সদস্যরা নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ২৫ পুলিশ সদস্য নিহত হন ৫ আগস্ট। আগের দিন ৪ আগস্ট প্রাণ যায় ১৪ জনের।
নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কনস্টেবল পদ মর্যাদার ২১ জন নিহত হয়েছেন। ১১ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ৮ জন, পরিদর্শক ৩ জন ও একজন নায়েকও রয়েছেন নিহতের তালিকায়।
একক থানা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৫ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায়।
এখন পর্যন্ত শুধু এনায়েতপুর থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ১৫ পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে।
গত ২৫ অগাস্ট রাতে থানার এসআই আবদুল মালেক বাদী হয়ে ওই মামলা দায়ের করেন। সেখানে আওয়ামী লীগের চার নেতাসহ অজ্ঞাতনামা ৫-৬ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।
হামলায় প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে মামলাটিতে।
এই মামলার আসামি করা হয়েছে এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান (বাচ্চু), সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুল্লুক চাঁন, বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে।
এজাহারে বলা হয়েছে, গত ৪ অগাস্ট দুপুর ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এনায়েতপুর থানার সামনে সমবেত হয়। এ সময় ওসি আবদুর রাজ্জাক হ্যান্ড মাইক দিয়ে সমবেত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন এবং তারা চলে যান। পরে আসামি আহমদ মোস্তফা খানের নেতৃত্বে অন্য আসামিরাসহ পাঁচ থেকে ছয় হাজার দুষ্কৃতকারী দেশি অস্ত্র নিয়ে থানায় হামলা চালায়।
হামলাকারীরা পুলিশের কোয়ার্টার ও ওসির বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। আসামিরা থানা কম্পাউন্ডে উপপরিদর্শক (এসআই) তহছেনুজ্জামান, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ওবায়দুর রহমান, কনস্টেবল আরিফুল আজম, রবিউল আলম শাহ, হাফিজুল ইসলাম, শাহিন, রিয়াজুল ইসলামকে পিটিয়ে ও ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক, এসআই আনিছুর রহমান, এসআই রহিজ উদ্দিন খান, এসআই প্রনবেশ কুমার বিশ্বাস, কনস্টেবল আবদুস সালেক, কনস্টেবল হানিফ আলী থানার পাশের বাবু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আসামিরা সেখানে গিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে তাদের হত্যা করে।
মোস্তফা খানের অবৈধ দাবি মেনে না নেওয়ায় ‘পুলিশের ওপর ক্ষোভ’ থেকে এই হামলা চালানোর অভিযোগ এনে এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এক স্কুল শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা এক আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে এর আগেও মোস্তফা খানের নেতৃত্বে ৪৫০-৫০০ জন থানা ঘেরাও করেছিল।
পুলিশ সদস্য নিহতের বিষয়ে ঢাকায় কোনো মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার বলেন, “শুধু পুলিশ সদস্যই মারা যাননি, থানা ফাঁড়িগুলোতে হামলা চালিয়ে অনেক সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ ও নথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে আমাদের কাজ চলছে, আইনগতভাবে যা যা করা দরকার, তার সবই করা হবে।”
তিনি বলেন, “থানায় অনেক মামলার আলামত থাকে, যেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কীভাবে কী করা যায়, যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।”