সেই ঢাকা গেইট, এই ঢাকা গেইট

মেয়র তাপস বলেন, “সারাবিশ্বে আমরা অনেক কিছু দেখি। আমরা দুবাইয়ে বড় বড় অট্টালিকা দেখি। কিন্তু সেগুলো নতুন করে নির্মিত। তারা নতুন অনেক কিছু করতে পারবে, কিন্তু চারশ বছরের পুরানো এই ঢাকা ফটক ও কামান দুবাইয়েও পাওয়া যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2024, 02:32 PM
Updated : 24 Jan 2024, 02:32 PM

অযত্ন ও অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসা ঢাকা গেইটকে সংস্কার করে তার পুরানো রূপে ফিরিয়ে এনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বুধবার বিকেলে এ স্থাপনার উদ্বোধন করেন। 

তিনি বলেন, “আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল ঢাকা শহরকে তার ঐতিহ্যের জায়গায় ফিরে আনা। সেই প্রতিশ্রুতির একটি বড় অর্জন আজকে করতে পেরেছি। মীর জুমলার ঐতিহাসিক ঢাকা ফটককে আমরা আবারও সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারলাম, পুনরুজ্জীবিত করতে পারলাম। 

“একটি ইতিহাসকে আমরা আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছি। আমরা এখানে দুটি বিষয় পুনরুজ্জীবিত করেছি, একটি হলো ঢাকা ফটক। আরেকটি হলো মীর জুমলার আসাম অভিযানের শেষ নিদর্শন বিবি মরিয়ম কামান। এখন আমরা এটাকে উন্মুক্ত জাদুঘর বলতে পারি।” 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে জরাজীর্ণ ‘ঢাকা গেইট’র নান্দনিকতা ফেরাতে ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। 

গত বছরের মে মাসে সংস্কার কাজ শুরু হয়, যা সম্প্রতি শেষ হয়। প্রায় ৮২ লাখ টাকা খরচ করে এ গেইট সংস্কার করেছে ঠিকাদার কোম্পানি আহনাফ ট্রেডিংস। 

প্রত্নতত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ ফটকটির নতুন নকশা তৈরি করেন। সেই নকশার আদলেই নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। 

নতুন সংস্কারে ফটকের আশেপাশে দর্শনার্থীদের জন্য বসার জায়গা করা হয়েছে। পাশাপাশি আছে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা। মীর জুমলার আসাম অভিযানের ‘বিবি মরিয়ম’ কামানটি ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা গেইটের পাশে স্থাপন করা হয়েছে। 

মেয়র তাপস বলেন, “সারাবিশ্বে আমরা অনেক কিছু দেখি। আমরা দুবাইয়ে বড় বড় অট্টালিকা দেখি। কিন্তু সেগুলো নতুন করে নির্মিত। তারা নতুন অনেক কিছু করতে পারবে, কিন্তু চারশ বছরের পুরানো এই ঢাকা ফটক ও কামান দুবাইয়েও পাওয়া যাবে না। এটা হল আমাদের ঐতিহ্য ও গর্বের জায়গা। নতুন প্রজন্ম ও বাঙালিদের জন্য এই স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। 

“এই কামানটা চারশ বছরের, আবার চারশ বছর পরও মানুষ এটা দেখতে আসবে। বহির্বিশ্ব থেকে পর্যটকরা আসবে।” 

ঢাকা ফটক রক্ষণাবেক্ষণে লোকবল নিয়োগ দেওয়ার কথাও বলেন মেয়র। তিনি ঢাকা ফটকে কোনো পোস্টার না লাগাতে সবাইকে অনুরোধ করেন। 

এ বছর জুন মাসের মধ্যে পুরান ঢাকার লালকুঠি সংস্কার করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা অনুষ্ঠানে দেন মেয়র। 

তিনি বলেন, “আমরা নদী থেকে আমাদের শহর দেখতে পারি না। নদী থেকে যাতে লালকুঠি দেখা যায়, সেজন্য আমরা বলেছি, সামনে থেকে লঞ্চঘাট, পন্টুন সরিয়ে ফেলতে হবে। নদীকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে নদী থেকে লালকুঠি, আহসান মঞ্জিল দেখা যায়।” 

ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম অনুষ্ঠানে বলেন, “এটি ঢাকা তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্য রক্ষা করার একটি মহতী উদ্যোগ। এটা একটি অস্বাভাবিক কাজ। ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে আরও অনেক স্থাপনা আছে, অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে অনেক গবেষক ও ইতিহাসবিদ কাজ করে যাচ্ছেন। 

“আমার বিশ্বাস, আমাদের মেয়র এ বিষয়গুলোকে রক্ষা করবেন এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আমাদের বাঙালির চেতনা ও মূল্যবোধ আরও জাগ্রত করতে সক্ষম হবেন।” 

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, “১৯৭২ সাল থেকেই আমরা ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে বলে এসেছি ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার জন্য। মির্জা আব্বাস মেয়র থাকার সময় থেকেই আমি এটি বলে আসছি। কিন্তু তখন পুরনো নথিপত্র আর্কাইভসে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি। 

“ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তাপস ঢাকা দক্ষিণকে ছয়টি ঐতিহ্য বলয়ে ভাগ করার সিদ্ধান্ত দেন। সে অনুযায়ী প্রথম কাজ হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এই ফটকটিকে। কখনো মীর জুমলা ফটক, কখনো রমনা ফটক, আজকে ঢাকা ফটক নামে এটি উদ্বোধন হল।” 

বক্তব্যের শেষে তিনি এলাকার কাউন্সিলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, “এটা যেন নষ্ট না হয়, পোস্টার লাগানো না হয়।” 

মেয়রের উদ্দেশ্যে মুনতাসীর মামুন বলেন, এমন আরও ছোট ছোট স্থাপনা পুনরায় সংস্কারের কাজ যেন হাতে নেওয়া হয়।

ফটকের নতুন নকশাকার অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ, মেয়র তাপসের স্ত্রী আফরিন তাপস ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

ইতিহাসের পাতায় 

ঐতিহাসিক ঢাকা গেইট তিনটি অংশে বিভক্ত। পশ্চিমাংশ পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ভবনের পাশ, পূর্বের অংশ পড়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার সমাধির প্রবেশপথের সামনে এবং মাঝের অংশ পড়েছে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসিগামী সড়ক দ্বীপে। বর্তমানে ফটকটির উপর দিয়ে মেট্রোরেল চলাচল করে।

কখন এবং কেন রমনার এই ফটকটি নির্মাণ হয়েছিল তা নিয়ে অবশ্য ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।

এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষে বলা হয়েছে, ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ফটকটি নির্মাণ করেছিলেন মীর জুমলা।

তবে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এ ধারণার সঙ্গে একমত নন। তার ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী ঢাকা’ গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড’স ১৯২৫ সালের পর রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে রেসকোর্স তৈরি করেছিলেন।

মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য ড’স রেসকোর্সের উত্তর পূর্ব দিকে তৈরি করেছিলেন একটি রাস্তা। রাস্তার প্রবেশমুখে দুটি স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। ‘প্রচলিত মত’ অনুসারে এ দুটি স্তম্ভের নাম মীর জুমলার ফটক।

অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেন, “জনশ্রুতি আছে, মীর জুমলা ঢাকা উত্তরের গেইট নির্ধারণের জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এখন যে গেইটটা আছে, সেটা ব্রিটিশ আমলে চার্লস ড’স তৈরি করেন।

“পূর্বদিকের যে অংশটা, সেটা পাকিস্তান আমলে আজম খানের সময়ে তৈরি করা হয়েছে। রাস্তাটা যখন বড় করে, তখন ফটকটির ৫০ শতাংশ সরিয়ে ফেলা হয়।”

তবে এটি মুঘল আমলেই নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মনে করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। উপমহাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও এমিরেটাস অধ্যাপক ড. এ এইচ দানীর ভাষ্য, এর গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচের।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহনেওয়াজ মনে করেন, এটি মুঘল আমলেই তৈরি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছেন, “ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকার সীমানা আরও বড় ছিল। তখনই সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, নবাবদের আমলে হয়েছে শাহবাগ। ঔপনিবেশিক আমলে হলে এ গেইট আরও উত্তরে হত।

“তখন যদি এটা নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তাহলে দেখা যাবে পেছনেও শহর এবং সামনেও শহর। মাঝখানে তো গেইট হওয়ার কথা নয়। গেইট তো হবে শহরের প্রবেশ পথ। কলোনিয়াল পিরিয়ডে গেইট দিয়ে আলাদা করার প্রবণতা দেখা যায় না। এই গেইট করার প্রবণতা মুঘল আমলেই ছিল।”